১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৯:৫৯:২১ পূর্বাহ্ন


চলনবিলের বারুহাস মেলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সৌরভ সোহরাব, সিংড়া (নাটোর) প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৪-২০২৩
চলনবিলের বারুহাস মেলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট চলনবিলের বারুহাস মেলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট


আগামীকাল বুধবারবার বিকেল থেকেই শুরু হচ্ছে চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী সিরাজগঞ্জের তাড়াশের বারুহাস মেলা। এই মেলা মুলত চলনবিলের লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করে আসছে প্রায় দেড় শ বছর ধরে। চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলা সদর হতে ১০  কিঃ দুরে  জমিদার খ্যাত বারুহাস গ্রামে প্রতি বছর চন্দ্র চন্দ্রিমার ১৩ তারিখকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেই মোতাবেক এবছরের মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামীকাল বুধ ও বৃহষ্পতিবার। মেলাটি  বুধবার বিকাল থেকে শুরু হলেও মুল মেলা হবে  বৃহষ্পতিবার দিনব্যাপী। পরের দিন রবিবার জমে উঠবে বউ মেলা।

এ মেলার বড় আকর্ষন দেশী প্রজাতির বড় মাছ,নানান স্বাদের দই মিষ্টি,চিনির তৈরী হাতি ঘোড়া আকৃতির সাইচ,কাঠ ফার্নিচারের সামগ্রী,তরতাজা দেশী গরু-মহিষ ও খাসির মাংস,হরেক রকম খেলনা,শীতল পাটি,বেত বাঁশের তৈরী গৃহস্থালি জীবনের  নানান পণ্য।

মেলাটির ইতিহাস সন্ধানে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে সিংড়া-তাড়াশ সীমান্তবর্তী ভদ্রা নদীর পশ্চিমে তৎকালীন বিয়াশ গ্রামের প্রভাবশালী হিন্দু জমিদার সর্ব প্রথম মেলাটির আয়োজন করে। সিংড়া-বারুহাস রাস্তা সংলগ্ন কালি বাড়ি মন্দিরকে কেন্দ্র করে মেলাটি গড়ে উঠে। মেলার দিনে দেবদেবীর পুজা করাই ছিল সেসময়কার হিন্দু জমিদার গণের মুল লক্ষ্য। এ ভাবে কয়েক দশক কালি মন্দিরের মেলা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। হিন্দুদের মেলা হলেও এলাকার মুসলমানরাও মেলার উৎসবে অংশ নিত। এক সময় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটতে শুরু হলে  হিন্দুদের জমিদারী প্রভাব কমতে থাকে এবং মুসলমান জমিদারী প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে। এভাবে দেশের শিল্প সংস্কৃতিরও মুসলমান জমিদারদের নেতৃত্বে আসতে থাকে। 

স্থানীয় প্রবীণদের তথ্য অনুযায়ী এরকম ঘটনার প্রেক্ষাপটে  তৎকালীন বারুহাস মুসলিম জমিদারের নেতৃত্বে সড়াবাড়ি, সান্দ্রা, দিঘড়ীয়া, গাড়াবাড়ি, সরিষাবাড়ি, ঠেঙ্গাপাকুড়ীয়া সহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রধান গণের সিদ্ধান্তে কালিবাড়ির মেলা স্থানান্তর করে ভদ্রাবতী নদীর তীরে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রবীণ ব্যক্তিদের তথ্য মতে বিয়াশ কালি বাড়ি থেকে বারুহাস ভদ্রাবতীর তীরে মেলা বসাতে কয়েক বছর সময় লেগেছে। যাই হোক বারুহাস জমিদার বাড়ি সংলগ্ন ভদ্রাবতী নদীর তীরে মেলাটি বসতে থাকলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মেলার জৌলুস বাড়তে থাকে। তৎকালীন বারুহাস জমিদার পরিবার সহ এলাকার গণমান্য মানুষের পৃষ্ঠপোষকতায় মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই মেলার সুনাম চলনবিল ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বারুহাস গ্রাম সংল্গ ভদ্রাবতী নদীর তীর সংলগ্নে মেলা বসাতে মেলাটির নাম হয়ে উঠে ভাদাই মেলা। ভদ্রাবতীকে স্থানীয় লোকজন ভাদাই নামে চিনত। ভাদাই মেলার সুনাম এতো বেশি ছড়িয়ে গিয়েছিল যে বগুড়া,সিরাজগঞ্জ,নাটোর,পাবনা সহ অনেক দুর দুরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা মেলায় আসতো। শৌখিন মানুষেরা আসতো গরু ও মহিষের গাড়ী নিয়ে।

মেলার রাতে গাড়ির বহর নিয়ে আসতো। একেকটা বহরে ৩০থেকে ৪০টি গরু-মহিষের গাড়ী। তারা বগুড়া সহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসতো। মেলার পাশে গাড়ীর বহর থামিয়ে চাদর টানিয়ে আশ্রয়ান তৈরী করত। এখানেই চলতো রান্নার কাজ। মেলার কেনা কাটা আর ঘুরা ফেরা শেষ করে তারা মনের আনন্দে বাড়ি ফিরতো। ৮০ থেকে ৯০ দশকের শেষ পযর্ন্ত অর্থাৎ ২০০০ সাল পর্যন্তও ভাদাই মেলার জৌলুস ছিল চোখে পড়ার মত। বারুস, সড়াবাড়ি, সানড়া, দিঘড়ীয়া, তালম, মনোহরপুর, ছাচান দিঘী, সান্দুরিয়া, বিনোদপুর, সিংড়ার ঠেঙ্গাপাকুড়ীয়া, গাড়া বাড়ি, সরিষা বাড়ি, বিয়াশ, আয়েশ, বড় আদিমপুর সিংড়া ও তাড়াশ উপজেলার প্রায় ২০/২২ টি গ্রামের বছরের আনন্দ উৎসবের মধ্যে সেরা উৎসব হয়ে উঠে ছিল এই মেলাকে কেন্দ্র করেই।

মেলার জায়গা সংকট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব সব মিলেই আজ মেলার এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেড়শ বছরের এই ঐতিহ্যকে এ ভাবে হারিয়ে  দেওয়া যায় না। যে কোন মুল্যে এটাকে আগের মত ফিরিয়ে আনতে হবে। কারন এই সংস্কৃকি শুধু বারুহাস গ্রামের নয়। এই সংস্কৃতি আমাদের চলনবিলবাসির নিজস্ব সংস্কৃতি। এটা আমাদের অহংকার। এই সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আপনার আমার আমাদের সবার।