ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘সেই প্রকৃত মানুষ, যে তাঁর শরীরের মৃত্যুকে নয় বরং অন্তরের মৃত্যুকে ভয় করে।’ অন্তরের মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকতে পারা বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। বান্দার প্রতি আল্লাহর অনেক অনুগ্রহের কথা কোরআন-সুন্নায় ওঠে এসেছে। তা থেকে কিছু তুলে ধরা হলো-
১. اَلَمۡ یَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ هُوَ یَقۡبَلُ التَّوۡبَۃَ عَنۡ عِبَادِهٖ وَ یَاۡخُذُ الصَّدَقٰتِ وَ اَنَّ اللّٰهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِیۡمُ
‘তারা কি জানে না যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দাদের তওবাহ কবুল করেন এবং ‘সাদকা’ গ্রহণ করেন, আর নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (সুরা তওবাহ : আয়াত ১০৪)
হাদিসে পাকে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন তার সম্পূর্ণ পবিত্র সম্পদ থেকে কোনো একটি খেজুর সাদকা করে তখন সেটি আল্লাহ নিজ ডান হাতে গ্রহণ করেন, তারপর সেটা আল্লাহর হাতে এমনভাবে বেড়ে উঠে যে, পাহাড়ের মত প্রকাণ্ড হয়ে পড়ে। (মুসলিম: ১০১৪)
২. اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَتۡقٰکُمۡ
‘... তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশী মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাকওয়া সম্পন্ন।... (সুরা হুজরাত : আয়াত ১৩)
আল্লাহর কাছে মর্যাদা ও উৎকৃষ্টতার মাপকাঠি এমন বংশ, গোত্র ও আভিজাত্য নয়, যা গ্রহণ করা কোনো মানুষের এখতিয়ারেই নেই, বরং মাপকাঠি হলো- আল্লাহভীরুতা; যা অবলম্বন করা মানুষের ইচ্ছা ও এখতিয়ারভুক্ত। একটি হাদিসে নবিজি বলেছেন-
‘আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তোমাদের বংশ ও আভিজাত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। তোমাদের মধ্যে যে বেশি আল্লাহভীরু সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী।’ (ইবনে জারীর ৩১৭৭২) আরও এক হাদিসের ভাষ্য হচ্ছে, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন।’ (মুসলিম ২৫৬৪, ইবনে মাজাহ ৪১৪৩)
৩. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ ঘোষণা করেন-
أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلاَ ذَكَرْتُهُ فِي مَلاَ خَيْرٍ مِنْهُمْ وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
‘আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তবে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’ হাত এগিয়ে যাই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌঁড়ে যাই। (বুখারি ৭৪০৫)
৪. مَنۡ عَمِلَ صَالِحًا مِّنۡ ذَکَرٍ اَوۡ اُنۡثٰی وَ هُوَ مُؤۡمِنٌ فَلَنُحۡیِیَنَّهٗ حَیٰوۃً طَیِّبَۃً ۚ وَ لَنَجۡزِیَنَّهُمۡ اَجۡرَهُمۡ بِاَحۡسَنِ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ
‘যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।’ (সুরা নাহল : আয়াত ৯৭)
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুফাসসিরের মতে এখানে ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বলতে দুনিয়ার পবিত্র ও আনন্দময় জীবন বোঝানো হয়েছে। হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু অর্থ করেছেন স্বল্পে তুষ্টি। হজরত দাহহাক বলেন, হালাল রিজিক ও দুনিয়াতে ইবাদাত করার তাওফিক।
তাফসীর অনুযায়ীও এরূপ অর্থ নয় যে, সে কখনো অনাহার-উপবাস ও অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হবে না। বরং অর্থ এই যে, মুমিন ব্যক্তি কোনো সময় আর্থিক অভাব-অনটন কিংবা কষ্টে পতিত হলেও দুটি বিষয় তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেয় না।
এক. অল্পেতুষ্টি এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপনের অভ্যাস, যা দারিদ্র্যের মাঝেও কেটে যায়।
দুই. তার এ বিশ্বাস যে, এ অভাব-অনটন ও অসুস্থতার বিনিময়ে আখেরাতে সুমহান, চিরস্থায়ী নেয়ামত পাওয়া যাবে। ঠিক কাফের ও পাপাচারীর অবস্থার বিপরীত। কারণ সে অভাব-অনটন ও অসুস্থতার সম্মুখীন হলে তার জন্য সান্তনার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
তাফসিরে আহসানুল বয়ানে এসেছে, حياة طيبة সুখী জীবন বলতে পৃথিবীর জীবন, কারণ পরকালের জীবনের কথা পরের আয়াতে বলা হয়েছে। যার সারমর্ম হলো- একজন চরিত্রবান মুমিন সৎ ও ধর্মভীরু জীবন যাপনে, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত ও অল্পে তুষ্ট হওয়াতে যে পরম সুখ-স্বাদ অনুভব করে, তা কোনো কাফের ও পাপী ব্যক্তি পৃথিবীর সকল সুখ ভোগ করলেও সে সুখ-স্বাদ পায় না। বরং সে এক ধরনের মানসিক অশান্তি ভোগ করে।
৫. فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا
‘কাজেই যে তার রব-এর সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকাজ করে ও তার রব-এর ইবাদাতে কাউকেও শরীক না করে।’ (সুরা কাহফ : আয়াত ১১০)
এ আয়াতকে দ্বীনের ভিত্তি বলা হয়ে থাকে, এখানে এমন দুটি শর্ত বর্ণনা করা হয়েছে যার উপরই সমস্ত দ্বীন নির্ভর করছে। এক. কার ইবাদত করছে; দুই. কীভাবে করছে। একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে ইখলাসের সঙ্গে। আবার সে ইবাদত হতে হবে নেক আমলের মাধ্যমে। আর নেক আমল হবে একমাত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথে আমল করলেই।
নেক আমল হল তাই, যা সুন্নাহর মোতাবেক হয়। অর্থাৎ যারা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতে দৃঢ়-বিশ্বাসী প্রথমত: তাদের উচিত প্রতিটি কাজ সুন্নাহ মোতাবেক করা, দ্বিতীয়ত: আল্লাহর ইবাদতে কাউকেও শরীক না করা। যেহেতু বিদআত ও শিরক; এই দু’টি হলো- আমল পণ্ড হওয়ার মূল কারণ। শিরক ও বিদআত থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে এ আয়াতে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ প্রতিটি মুসলিমকে শিরক ও বিদআত থেকে দূরে রাখুন।
বান্দার প্রতি আল্লাহর সব অনুগ্রহ পরিপূর্ণ রাখতে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো ভাষায় তার কাছে সাহায্য চাওয়ার বিকল্প নেই। তাই নিজেদের মনকে আল্লাহমুখী করে রাখতে হাদিসের এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়া-
৬. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দোয়া বেশি পাঠ করতেন-
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
উচ্চারণ : ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ছাব্বিত কালবি আলা দিনিকা।’
অর্থ : ‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত (দৃঢ়) রাখো।
আমি (হজরত আনাস) বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা ঈমান এনেছি আপনার উপর এবং আপনি যা নিয়ে এসেছেন তার উপর। আপনি আমাদের ব্যাপারে কি কোনা রকম আশংকা করেন? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’, কেননা, আল্লাহ তাআলার আঙ্গুলসমূহের মধ্যকার দুটি আঙ্গুলের মাঝে সমস্ত অন্তরই অবস্থিত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা তা পরিবর্তন করেন।’ (তিরমিজি ২১৪০)