২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:০২:১৯ অপরাহ্ন


দীর্ঘ হচ্ছে ডলার সংকট
ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১১-২০২২
দীর্ঘ হচ্ছে ডলার সংকট দীর্ঘ হচ্ছে ডলার সংকট


দীর্ঘই হচ্ছে ডলার সংকট। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে সংকটের তীব্রতা। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়াতে না পারায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও টান পড়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে আমদানি-রপ্তানির এলসি খুলতে পারছে না অনেক ব্যাংক। বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে সুবিধা বেশি পাওয়ায় সে পথেই রেমিট্যান্সের অর্থ হুন্ডি করে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।

সরকার চেষ্টা করেও বহির্বিশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের পরিবেশ ফেরাতে পারেনি। ফলে রেমিট্যান্সের খরাও কাটছে না। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বেচেও পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারছে না। এখনো খোলাবাজারে ১১২-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডলার। তবু বাজারে প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম বেঁধে দিলেও তা মানছে না অনেক ব্যাংক। এতে নির্ধারিত দামে ব্যাংকেও ডলার পাচ্ছেন না গ্রাহক।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলার সংকট কাটাতে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাপ্য সুবিধা। যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী তাদের সঠিক নির্দেশনা দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে কম খরচে পাঠাতে হবে। একই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় আমদানি আরও কমিয়ে আনতে হবে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, ডলারের অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। পাচার রোধের পাশাপাশি, যারা অর্থ পাচার করেন তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে বলে মনে করেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের যথেচ্ছ বিদেশ ভ্রমণ এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এ ক্ষেত্রেও জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সংকট কাটাতে ব্যাংকে বেঁধে দেওয়া হয়েছে ডলারের সর্বোচ্চ দাম। আর ডলারের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়ার পর প্রবাসী আয়ে বড় পতন হয়েছে। সেপ্টেম্বরে যে আয় এসেছে, তা গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৪৬ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

এক মাস আগেও, অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর-২০২২ রিজার্ভ ছিল ৩৬ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে রিজার্ভের পরিমাণ ৩০ বিলিয়নের নিচে। সেপ্টেম্বরে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫৪ কোটি ডলার, আগস্টে এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার। ফলে আগের মাসের তুলনায় আয় কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আর গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৭২ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত বছর সেপ্টেম্বরের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে ১১ শতাংশ। এদিকে আমদানি বাণিজ্যে ডলার-নির্ভরতা কমাতে চায় সরকার। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বব্যাপী মার্কিন ডলারের আধিপত্য চলছে। বাংলাদেশের ব্যাংক ও অব্যাংক খাতে প্রায় প্রতিদিনই হু হু করে ডলারের দাম বাড়ছে।

ইতিহাসের পাতায় রেকর্ড হয়েছে। একই সঙ্গে ইউরোর দামও বাড়ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। ডলার সংকটের কারণে আমদানির এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিদেশ ভ্রমণ, বিলাসী পণ্য আমদানিসহ ডলার খরচ কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিলেও সংকট কমছে না। বরং প্রতিদিনই এ সংকট তীব্র হচ্ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের তুলনায় আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে ডলারের আধিপত্য আরও বাড়ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়েছে। এক বছরে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেশি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে প্রায় ৯১৪ কোটি ডলার বেশি এবং এযাবৎকালের সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা ধরে) এ ঘাটতির পরিমাণ ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। গত অর্থবছর এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। ডলার সংকট প্রকট হওয়ায় সম্প্রতি দাম নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেও সংকট কমেনি। দামও কমেনি। সে সময় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) মিলে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। কিন্তু ব্যাংক খাতেও এ দামে ডলার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ইউরোপের দেশগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ায় সেখান থেকে প্রবাসী আয় আসা কমেছে। পাশাপাশি প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দুই ধরনের দাম বেঁধে দেওয়ার প্রভাবও পড়েছে প্রবাসী আয়ে। দেশে ডলারের প্রধান দুটি উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। এ দুটি উৎসে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক ধারা দেখা দেওয়ায় নতুন করে আবার উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সংশ্লিদের মধ্যে। বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানিকারকরা পড়েছেন বিপাকে।

জানা গেছে, ডলার সংকট মেটাতে গত সাত মাসে রিজার্ভ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে হয়েছে ৩ হাজার ৬৪০ কোটি বা ৩৬ বিলিয়ন ডলার। তবে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের পুরোটাই ব্যবহারযোগ্য নয়। কারণ বিভিন্ন খাতে রিজার্ভের আট বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ফলে দেশে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৯০০ কোটি বা ২৯ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বৈধ চ্যানেলে ১৫৪ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রবাসীদের এ আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ডলার বা ১০ দশমিক ৮৪ শতাংশ কম। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এদিকে চলতি বছর আগস্টে প্রবাসীদের কাছ থেকে বৈধ চ্যানেলে ২০৩ কোটি ডলার আসে। অর্থাৎ আগের মাসের তুলনায় আয় কমে প্রায় ২৫ শতাংশ।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, এ পরিসংখ্যান দেখে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। মাসওয়ারি হিসাব ধরে রেমিট্যান্স হার বিবেচনা করা যায় না। কোনো মাসে কম আসবে, কোনো মাসে বেশি। দেখতে হবে বার্ষিক রেমিট্যান্সে তফাত হয় কি না। দেশে যখন বন্যা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় কিংবা কোনো উৎসব হয় তখন চালসহ অন্যান্য পণ্যের সংকট দেখা দেয়। দেশে থাকা স্বজনদের কষ্ট লাঘবে ধারদেনা করে কিংবা সঞ্চিত টাকা থেকে প্রবাসীরা বাড়িতে বেশি টাকা পাঠান।

প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় উৎসাহ দিতে সরকার করোনাকালে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে। এখন সেটা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এই প্রণোদনার সুফল হিসেবে করোনাকালে রেমিট্যান্স কমেনি। যদিও রেমিট্যান্স ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। সে সময় বিদেশে অনেকে কাজ হারিয়ে ঘরবন্দি ছিলেন।

কিন্তু দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে রেমিট্যান্সের চাকা সচল রাখেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে বেশি লাভ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে হয়রানি নেই। যেখানে ব্যাংকে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন নিরীহ প্রবাসীরা শ্রমিকরা। সে জন্য তারা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।