২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১২:৫৫:৩৮ অপরাহ্ন


নগরীতে অভিযান-জরিমানা হলেও অতিরিক্ত দামেই চলছে চিনি বিক্রি
ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-১০-২০২২
নগরীতে অভিযান-জরিমানা হলেও অতিরিক্ত দামেই চলছে চিনি বিক্রি নগরীতে অভিযান-জরিমানা হলেও অতিরিক্ত দামেই চলছে চিনি বিক্রি


গত কয়েকদিন ধরে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাজশাহীর বাজারেও বৃদ্ধি পেয়েছে চিনির দাম। নব্বই টাকার বিপরীতে খোলা বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা দরে। কোন কোন পাইকারী ব্যবসায়ি দাম বৃদ্ধি পাওয়ার খবর পেয়ে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় মজুদও বৃদ্ধি করেছিলেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর রাজশাহী জেলা শাখার কর্তাদের হস্তক্ষেপে চিনির কৃত্রিম সংকট তৈরি ও বেশি দামে চিনি বিক্রির দায়ে গত ২৪ অক্টোবর একাধিক ব্যবসায়িকে জরিমানাও করে অধিদফতরের দায়িত্বরত কর্তারা। কিন্তু, তবুও থেমে নেই নগরীর বাজারগুলোতে অতিরিক্ত মূল্যে চিনি বিক্রির পায়তারা। গতকাল নগরীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা ও পাইকারি দোকানগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে, বেশি মূল্যে চিনি বিক্রির কারসাজি। নগরীর অধিকাংশ খুচরা দোকানে মেলেনি চিনির উপস্থিতি। যারা আগে থেকেই রেখেছিলেন অতিরিক্ত চিনির মজুদ তারা খুচরা বিক্রি করছেন ১১০ থেকে ১১৫ টাকা দরে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্তৃক জরিমানার বেড়াজালে পড়ার ভয়ে নগরীর সাহেব বাজারের অধিকাংশ খুচরা বিক্রেতারা নিজেদের দোকানে রাখছেন না চিনির বস্তা বলে মন্তব্য বিক্রেতাদের। মুনাফা কম হওয়াতে চিনি বিক্রিতেও নেই কোন আগ্রহ বলেও মন্তব্য করেন সাহেব বাজারের অনেক খুচরা ব্যবসায়ি! সাহেব বাজারের অধিকাংশ পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দামের তালিকায় সকল প্রকার পণ্যের দাম উল্লেখ্য থাকলেও চিনির স্থলে লিখা ছিল ‘নাই’ শব্দটি।

খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে যাওয়ার পর তারা বলছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা চিনি দিচ্ছেন না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলাররা বাজারে চিনি ছাড়ছেন না। আবার ডিলারদের কাছে যাওয়ার পর তারা বলছেন, মিলগেট থেকে সরবরাহ আদেশে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী মিল মালিকরা চিনি ছাড় করছেন না। সাহেব বাজারের খুচরা মুদি ব্যবসায়ি আসগর খাঁন, লিটন, পিন্টু সহ অন্যান্য ব্যবসায়িরা জানান, দাম বৃদ্ধির পর থেকে তারা চিনি বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। কারণ হিসেবে নগরীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা ও মুদিখানার ব্যবসায়িরা রাজশাহীর সময় কে জানান, গেল সপ্তাহে চিনির পাইকারি দর ছিল ৮৮/৮৭ টাকা।

আর খুচরা বিক্রি ছিল ৯০ টাকা। কিন্তু, হঠাৎ করে সেই চিনির পাইকারি দর বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় ১০৮/১০৭ টাকা। দাম বৃদ্ধির কারণে খুচরা বাজারেও বেড়েছে চিনির দাম। কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা লাভের জন্য ক্রেতাদের সাথে প্রায়শই হচ্ছে তর্কবিতর্ক। যার করেণ, অনেক খুচরা ব্যবসায়ি নিজেদের দোকানে রাখছেন না চিনি। তারা আরো জানান, এক কেজি চিনি বিক্রি করে লাভ হচ্ছে দুই থেকে তিন টাকা মাত্র। আর অন্যদিকে, বেশি দরে চিনি বিক্রি করাতে ভোক্তা অধিকার কর্তৃক জরিমানা গোনার ভয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করছেন না চিনি বলেও জানান তারা। চিনির মূল্য হঠাৎ করে বৃদ্ধি পাওয়াতে নগরীর পাইকারী ব্যবসায়িরা দোষারোপ করছেন চিনি রিফাইনারি কোম্পানিগুলোকে। নগরীর সাহেব বাজারস্থ পাইকারি ব্যবসায়ি আলী আহমেদ ও মোজাম্মেল জানান, চিনি পরিশোধনকারি কোম্পানিগুলোতে রাজশাহী থেকে ট্রাক পাঠালেও তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ না দিয়ে কালক্ষেপন করছেন। দশ থেকে পনের দিন পর্যন্ত ট্রাকগুলো মিল গেটে অবস্থান করার পর পাচ্ছে চিনি। প্রতিদিন ট্রাকের ড্রাইভারদেরকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। সময়ক্ষেপনের কারণ জানতে চাইলে পাইকারি ব্যবসায়ি আলী আহমেদ জানান, টিসিবি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) ও বড় বড় খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানের ট্রাকগুলোকে রিফাইনারি কোম্পানিগুলো আগে চিনি সরবরাহ করছে। তারপর আমরা পাচ্ছি। তবুও চাহিদার বিপরীতে পাচ্ছি কম। একদিকে ট্রাক ভাড়া বেশি তো অন্যদিকে, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম বিধায় চিনির এমন সংকট বলে দাবি নগরীর পাইকারি ব্যবসায়িদের।

নগরীর সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর থেকে অভিযান ও জরিমানা অব্যাহত থাকায় বিক্রেতারা একত্রিত হয়ে চিনি বিক্রি বন্ধ করেছেন। এটাও তাদের কৃত্রিম সংকট তৈরিসহ দাম বৃদ্ধির এক ধরনের নতুন কৌশল। নগরীর কোন কোন দোকানি বলছেন, চিনি বিক্রি না করলে কি হবে। অন্য পণ্যের বিক্রি থেকে আমরা মুনাফা তুলে নেবো। সরবরাহকারি-পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের রোষানলে পড়েেেছন সাধারণ ক্রেতারা। নগরীর অধিকাংশ বাজার ও দোকানগুলোতে চিনির উপস্থিতি না থাকায় ক্রেতারা পড়েছেন চরম বিপাকে। পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, সাহেব বাজারে চিনির খুচরা ক্রেতার আগমন আগের চাইতে অনেক কম। কিন্তু, মিষ্টি ও বেকারি কারখানায় নিয়মিত সরবারহ অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, গতকাল দেশের একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য নিয়ে তারা দেখেছেন, দেশে চিনির কোনো ঘাটতি নেই। বর্তমানে অপরিশোধিত চিনির মজুদ ও পাইপলাইনে মোট ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৫ মেট্রিক টন চিনি মজুদ আছে। তারপরও বাজারে হঠাৎ চিনির সরবরাহ কমে যাওয়ার পেছনে তারা চিনি পরিশোধনকারী মিল মালিকদের কিছুটা দায় দেখছেন। সফিকুজ্জামান আরো বলেন, চিনির বাজারে হঠাৎ সংকটের পেছনে কিছু মিল মালিকের দায় অস্বীকার করা যাবে না। তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। কর্মকর্তারা জানান, ডিলারদের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটি মিলে দেখা গেছে, একাধিক সরবরাহ আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ থেকে ১২ দিন পর চিনি সরবরাহ করা হয়েছে। ডিলাররা দাবি করেছেন, সরবরাহ আদেশের মেয়াদ অনুযায়ী চিনি ট্রাকে লোড না করায়, মিলগেটে অপেক্ষারত ট্রাককে প্রতিদিনের অতিরিক্ত ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে এই অতিরিক্ত খরচ চিনির দামে যুক্ত হয়েছে, যার জন্য প্রকৃত অর্থে মিল মালিকরাই দায়ী। পরিশোধনকারী মিল মালিকরা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে হঠাৎ চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। অবশ্য উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার পেছনে গ্যাস সংকটকে দায়ী করেছেন মিল মালিকরা।

উল্লেখ্য, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিম মেঘনা সুপার রিফাইনারি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লি., দেশবন্ধু সুগার মিল এবং চট্টগ্রামের এস আলম সুগার রিফাইনারিতে অভিযান চালিয়ে এসব অনিয়ম দেখতে পায়।