১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ০৮:৪৮:৫৪ পূর্বাহ্ন


মাঠে মাঠে ফসলের ঋতু হেমন্তের সুগন্ধ, নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব!
মঈন উদ্দীন, রাজশাহী:
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১০-২০২২
মাঠে মাঠে ফসলের ঋতু হেমন্তের সুগন্ধ, নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব! মাঠে মাঠে ফসলের ঋতু হেমন্তের সুগন্ধ, নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে নবান্ন উৎসব!


কৃষিভিত্তিক বরেন্দ্র অঞ্চল ঋতুচক্রে হেমন্তকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। এ অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান সাধারণত এ ঋতুতে ঘরে তোলা হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠে-ঘাটে এরইমধ্যে শুরু হয়েছে ধানের সুগন্ধ। কার্তিক মাসের প্রথম থেকে শুরু মাঠের রং ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে সবুজ থেকে হলুদ হয়ে সোনালিতে। কোথাও ধানে কেবল দুধ জমেছে, কোথাও ধান হলুদ হতে শুরু করেছে। আর অগ্রহায়ণ মানেই ধানের রং সোনালি, শুরু হয় কৃষকের সুখের দিন। এ সুখের দিনে হবে নবান্ন। সুগন্ধি নতুন চাল, নতুন সবজি, নতুন ডাল, নতুন মাছে নবান্ন হবে হেমন্তের শেষে।

বরেন্দ্র অঞ্চল শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে এখন মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। কার্তিক মাসে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ।  বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, নীলফামারীসহ কয়েকটি জেলার কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছেন এখন। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমান কিষাণী। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে তাদের। তবে মূল অপেক্ষা নবান্ন উৎসবের। পরের মাস অগ্রহায়ণের প্রথম দিন নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হবে। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবটি নবান্ন নামে পরিচিতি পায়। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। ইতিহাস বলে, হাজার-হাজার বছর আগে কৃষি প্রথা চালু হওয়ার পর থেকেই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে।

হেমন্তকালে এ উৎসব ছিল সার্বজনীন। নবান্ন ঘিরে (নতুন ধান ঘরে তোলা উৎসব) গ্রামে গ্রামে চলত পিঠা-পুলি ও খির-পায়েশের উৎসব। হেমন্তে ধান কাটা উৎসবে যোগ হতো সারি সারি গরু ও মহিষের গাড়ি। মাঠে মাঠে কৃষকরা দল বেধে ধান কাটা উৎসবে যোগ দিতেন। আর গেয়ে উঠতেন জারি-সারি ভাটিয়ালিসহ নানা ধরনের গান। এক কোথায় গ্রামীণ জীবনে হেমন্তের আবহ ছিল অন্তপ্রাণে গাঁথা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,  ৪৭ এ দেশভাগের পর এই উৎসব ধীরে ধীরে কদর হারাতে থাকে। এখন সেটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামের পিঠা এসে যোগ হয়েছে শহরের হোটেল ও ফাস্ট ফুডের দোকানে। পিঠা উৎসবও এসে যোগ হয়েছে শহরের মেলা প্রাঙ্গণে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ঐতিহ্য থেকে। হেমন্তে ধান কাটা উৎসবে আর দেখা মেলে না সারি সারি গরু ও মহিষের গাড়ি। এখন সেখানে যোগ হয়েছে ইঞ্জিন চালিত যান বা রিকশা ভ্যান। কিন্তু এখন আর সেই ঐতিহ্য নেই।      

রাজশাহীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণকারী গবেষকদের মতে, একসময় কার্তিক মাসে আশ্বিনের স্বল্প-উৎপাদনশীল আউশ ধান চাহিদার তুলতায় অনেক কম পেতেন কৃষকরা। কিন্তু এখন সেখানে যোগ হয়েছে উচ্চ ফলনশীল জাতের নানা ধরনের ধান। ফলে এখন কোনো কোনো এলাকায় ছোট ছোট আকারে কার্তিকের শুরুতেই ধান কাটার মাধ্যমে নবান্ন উৎসব দেখা গেলেও আগের সেই জৌলুস যেন নেই। আবার অগ্রহায়ণে একমাত্র আমনের একসময় বাঙ্গালী কৃষকদের ভরসা থাকলেও এখন প্রায় সারা বছরই উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উৎপাদন হচ্ছে। ফলে ধান কাটা ঘিরে গ্রামীণ উৎসব এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। যার ফলে পিঠা,পুলির আসরও তেমন বসছে না। সেইসব আসর শীতে শহরের বিভিন্ন মেলা প্রাঙ্গনে এসে যোগ হয়েছে।

রাজশাহীর তানোর এলাকার চান্দুড়িয়া গ্রামের বৃদ্ধ আনছার আলী বলেন, আমার বাপ-দাদাদের দেখেছি কার্তিকে অনেক মানুষ না খেয়ে থাকতো। নতুন ধান উঠলে সেই কষ্ট দূর হতো। নতুন ধানের আলো চাল ও সেই চালের আটা দিয়ে মুড়ি-মুড়কি, খৈ, পাটিসাপ্টা, ভাপা পিঠা, পায়েশসহ নানা ধরনের পিঠার আয়োজন হতো। এখন আর হয় না। কিন্তু এখন আর না খেয়ে কাউকে থাকতে দেখি না। সবাই অন্তত তিন বেলা খেতে পারছে। এটা দেখে খুব ভালো লাগে।