ইয়াওমুল জুমা সপ্তাহের সেরা দিন। জুমা ছাড়াও এই দিনে অন্য অনেক ইবাদতের বিনিময়ে রয়েছে অনেক সওয়াব ও পুরস্কার। গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের এ দিনে চারটি কাজ করা যাবে না। সেই কাজগুলো কী?
১. পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া মসজিদে যাওয়া
জুমার দিন গোসল করাকে আবশ্যক বলা হয়েছে। তাছাড়া পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। গোসল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে হাদিসের দিকনির্দেশনা-
> হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিনে প্রত্যেক সাবালকের জন্য গোসল করা ওয়াজিব।’ (বুখারি)
> হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ জুমার নামাজে আসলে সে যেন গোসল করে।’ (বুখারি, মুসলিম)
> হজরত ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু জুমার দিন দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রথম যুগের একজন মুহাজির সহাবা (জুমা পড়তে মসজিদে) এলেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে ডেকে বললেন, এখন সময় কত? তিনি বললেন, আমি ব্যস্ত ছিলাম, তাই ঘরে ফিরে আসতে পারিনি। এমন সময় আজান শুনে শুধু অজু করে নিলাম। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, শুধু অজুই? অথচ আপনি জানেন যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোসলের নির্দেশ দিতেন।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
> হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন জানাবাত (নাপাকি থেকে পবিত্রতার) গোসলের ন্যায় গোসল করে এবং নামাজের জন্য আগমন করে সে যেন একটি উট কোরবানি করলো। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমন করে সে যেন একটি গাভী কোরবানি করলো। তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমন করে সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কোরবানি করলো। চতুর্থ পর্যায়ে আগমন করলো সে যেন একটি মুরগি কোরবানি করলো। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমন করলো সে যেন একটি ডিম কোরবানি করলো। পরে ইমাম যখন খুতবাহ দেওয়ার জন্য বের হন তখন ফেরেশতারা (ইমামের খুতবাহ) উপদেশ শোনার জন্য (মসজিদে) উপস্থিত হয়ে থাকে।‘ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
তাই জুমার দিন সবার উচিত গোসল করা এবং মিসওয়াক করা। যদি সম্ভব হয় সুরভি লাগানো চাই। আর ভালো ও পরিচ্ছন্ন জামা পড়ে মসজিদে যাওয়া।
২. আজানের পরও কাজে থাকা
কুরআনুল কারিমের নির্দেশনা অনুযায়ী জুমার আজানের পর নামাজের প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কাজ করা বৈধ নয়; বরং তা গুনার কাজ। তাই জুমার আজান হওয়ার পর নামাজের প্রস্তুতিমূলক কাজ ছাড়া দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবিকা নির্বাহসহ সব কাজ কর্মই বন্ধ করে দেয়া জরুরি।
ইসলামিক স্কলার ও ফিকহবিদদের মতে, উক্ত আয়াতে আহ্বান (আজান) বলতে মৌলিকভাবে দ্বিতীয় আজান (খুতবার আজান) উদ্দেশ্য হলেও শব্দের ব্যাপকতার মাঝে জুমার প্রথম আজানও অন্তর্ভুক্ত। তাই তাফসীরবিদ ও ফিকহবিদগণের নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী প্রথম আজানের পরও জুমার প্রস্তুতিমূলক কাজ ব্যতিত ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্য যে কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া উক্ত আয়াতের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। অতএব তা নাজায়েয ও গুনার কাজ।
সুতরাং জুমার জন্য এক আজান দেয়া হোক আর দুই আজান দেয়া হোক; আজানের পর জুমার নামাজের প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কোনো কাজ করা বৈধ নয়। এ সময় অন্য কাজ করলে তা গুনার কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘লোকজন নিজেদের কাজকর্ম নিজেরাই করতেন। যখন তারা দুপুরের পরে জুমার জন্য যেতেন, তখন সে অবস্থায়ই চলে যেতেন। তাই তাদের বলা হলো, যদি তোমরা গোসল করে নিতে ভালো হতো।’(বুখারি ও মুসলিম)
তাছাড়া আল্লাহ তাআলা মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে পরবর্তী (১০নং) আয়াতে সুস্পষ্ট বক্তব্যও তুলে ধরেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘অতপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা/ব্যবসা-বাণিজ্য/কাজ-কর্ম) তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : আয়াত ১০)
৩. খুতবায় অমনোযোগী হওয়া
জুমার নামাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ খুতবা শোনা। বেশি মুসল্লি হওয়ার কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে যদি খুতবার আওয়াজ শোনা না যায়, তবে শব্দ না করে নীরব থাকা আবশ্যক। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি উত্তমভাবে অজু করে জুমার নামাজে এলো, মনোযোগ দিয়ে নীরবে খুতবা শুনলো, তার পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করলো, সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো।’ (মুসলিম)
৪. জুমার খুতবার সময় কথা বলা
চুপ থেকে জুমার খুতবা শুনতে হবে। খুতবা চলাকালীন কোনো আওয়াজ বা শোরগোল করা যাবে না। কারো সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তবেই জুমার দিন হবে গুনাহ মাফের উপায়। খুতবা শোনা হবে গুনাহ মাফের উপায়। হাদিসে পাকে এসেছে-
> হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি গোসল করে জুমার নামাজে এলো, এরপর সাধ্যমত (সুন্নাত) নামাজ আদায় করলো, এরপর ইমামের খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলো; এরপর ইমামের সঙ্গে (জুমার) নামাজ আদায় করল, এতে তার দুই জুমার মধ্যবর্তী দিনসমূহ এবং আরও তিন দিন (মোট ১০ দিনের) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’
> হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি গোসল করে জুমার নামাজে এলো, এরপর সাধ্যমত (সুন্নাত) নামাজ আদায় করলো, এরপর ইমামের খুতবা শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকলো; এরপর ইমামের সঙ্গে (জুমার) নামাজ আদায় করল, এতে তার দুই জুমার মধ্যবর্তী দিনসমূহ এবং আরো তিন দিন (মোট ১০ দিনের) গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’
> অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর যে ব্যক্তি (অহেতুক) কঙ্কর স্পর্শ করল সে অনর্থক, বাতিল, ঘৃণিত ও প্রত্যাখ্যানযোগ্য কাজ করলো।’ (মুসলিম)
> হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার নামাজ আদায়ের জন্য উত্তমরূপে অজু করে (মসজিদে) উপস্থিত হয়, এরপর চুপ করে মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনে, তার (ওই) জুমা থেকে (পরবর্তী) জুমা পর্যন্ত বরং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আর যে ব্যক্তি পাথর কুচি অপসারণ বা নাড়াচাড়া করলো সে অনর্থক কাজ করলো।’ (আবু দাউদ)
> হজরত সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিনে সুন্দর করে গোসল করবে, এরপর তেল ব্যবহার করবে এবং সুগন্ধি নেবে, তারপর মসজিদে গমন করবে, দুই মুসল্লির মাঝে জোর করে জায়গা নেবে না, সে নামাজ আদায় করবে এবং ইমাম যখন খুতবা দেবেন, (তখন) চুপ করে মনোযোগ সহকারে তাঁর খুতবা শুনবে। দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ে তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (আবু দাউদ)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাসময়ে আগে আগে জুমার নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।