হাঁপ ছেড়ে বাঁচার লড়াই আরও কঠিন হতে পারে


অনলাইন ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 15-08-2022

হাঁপ ছেড়ে বাঁচার লড়াই আরও কঠিন হতে পারে

দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সপ্তাহখানেক আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে কমে আসবে। গত ৫ আগস্ট ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম গড়ে ৪৭ শতাংশ বাড়ানোর পর অর্থমন্ত্রীই বলেছেন, এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। অবশ্য পরিস্থিতি অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করেনি। তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই পণ্যবাজার আরও অস্থির হয়ে পড়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের মতামত এবং বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রবণতা পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, আমদানি ব্যয়ের চাপ কিছুটা কমে আসা এবং জুলাই মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির কারণে অর্থনীতির চলমান সংকট শিগগির কমে আসবে বলে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে যে আভাস দেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা কম। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি ইতোমধ্যে মানুষের জীবযাত্রার ব্যয়ে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আবার ডলারের দাম কমারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ৪ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, দুই-তিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের ওপর চাপ কমে আসবে। সর্বশেষ লেনদেন দিনে গত বৃহস্পতিবার আমদানিকারকরা ডলার কিনেছেন ১০৯ থেকে ১১২ টাকা দরে। এক বছর আগে যা ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা ছিল। আর এক মাস আগে ছিল ১০২ থেকে ১০৫ টাকা।

অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন, সহসাই সংকট কেটে যাবে বলে মনে হয় না। কারণ এখনও প্রতি মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় থেকে যে পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, আমদানি বাবদ চলে যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি। আবার পশ্চিমা দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তার সুফল এখনও পুরোপুরি পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির যে সুযোগ বাড়িয়েছে, আমদানিকারকরা তা নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কারণ ভবিষ্যতে ডলারের মূল্য কোথায় ঠেকবে তার অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা ঋণ করে পণ্য আমদানিতে ঝুঁকি দেখছেন।

তবে আমদানি ব্যয় আগামীতে কমে আসবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ আমদানির জন্য দেশের ব্যাংকগুলোতে যেসব বড় এলসি খোলা হচ্ছে, সেখানে পণ্যমূল্য কত ধরা হচ্ছে আর বিশ্ববাজারে প্রকৃত মূল্য কত তা যাচাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেখা যাচ্ছে, অনেক এলসিতে যে দাম ধরে মূল্য প্রস্তাব করা হচ্ছে বিশ্ববাজারে ওই পণ্যের প্রকৃত মূল্য তার চেয়ে কম। ব্লুমবার্গ, রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন সংস্থার পণ্যমূল্যের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই দর যাচাই করছে। এতে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বড় এলসিতে পণ্যের যে দর ধরা হচ্ছে আর আন্তর্জাতিক বাজারের দরের মধ্যে অসংগতি পাওয়া যাচ্ছে। ওইসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকৃত দর ধরে এলসি মূল্য নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য খুব নিকট মেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট কেটে যাবে বলে মনে করেন না। যেসব কারণে বর্তমান সংকট, সেগুলো নিরাময় না হোক, প্রশমনের জন্যও কিছু সময় প্রয়োজন। বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশপাশি টাকার বিনিময় হারে অস্থিরতা কমাতে হবে। ব্যাংকে সুদের হার যৌক্তিকীকরণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা কমলেও সব ঠিক হয়ে যাবে মনে করার কারণ নেই। বৈশ্বিক পরিস্থিতি মন্দার দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে সুদের হার বাড়ছে। মূল্যস্ফীতিও সেসঙ্গে বাড়ছে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারগুলোতে চাহিদা কমে আসার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সুতরাং, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপাতত ভালো খবর নেই।

ড. দেবপ্রিয় মনে করেন, সরকারের ব্যয়সাশ্রয়ী কিছু পদক্ষেপের কারণে এবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। সুদের হার বাড়লে ব্যক্তি খাতের প্রবৃদ্ধিও কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কর আহরণও চ্যালেঞ্জিং হবে। সরকারের হাতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ কম থাকায় ভর্তুকি কমাতে হচ্ছে। এর প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার কত দ্রুত বাজেট সহায়তা পাবে, কত কিস্তিতে কী পরিমাণ অর্থ পাবে- এসব পরিস্থিতির ওপরও চাপ সামলানোর বিষয়টি নির্ভর করছে।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার রাজস্ব নীতির মাধ্যমে আমদানি ও সরকারি ব্যয় কমানোসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এখন মুদ্রানীতির মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হারের ওপর সীমা দ্রুত তুলে নিতে হবে। সুদের হারে সীমা থাকলে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যুদ্ধ করা কঠিন। তার মতে, সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এই মুহূর্তে টাকার মূল্য বাড়বে। টাকার মূল্য বাড়লে বিনিময় হারের ওপর চাপ কমাতেও তা সহায়ক হবে। তার মতে, বিনিময় হার কিছুটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় আমদানি কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে রপ্তানি খাত সহায়তা পাচ্ছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও আন্তঃব্যাংক লেনদেনের জন্য ৯৫ টাকায় ডলারের রেট ধরে রেখেছে। এ কারণে আন্তঃব্যাংক বাজার কাজ করছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া উচিত। তাহলে বিনিময় হার একটি জায়গায় স্থিতিশীল হতে পারে। তিনি মনে করেন, রেমিট্যান্সে এখন ১০৯ থেকে ১১০ টাকা দর পাওয়া যাচ্ছে। এখানে প্রণোদনা দেওয়ার আর দরকার নেই।

অর্থমন্ত্রীর চিহ্নিত চ্যালেঞ্জ আরও তীব্র হয়েছে: বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো এবং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখাসহ ৬টি বিষয়কে চলতি অর্থবছরের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। ডলারের ও জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির পর এসব চ্যালেঞ্জ আরও তীব্র হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে থাকবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম মাসেই তা ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে। অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির বাড়তি চাপ থাকবে। অন্যদিকে অনিশ্চিত পরিস্থিতি, বাড়তি মূল্যস্ফীতির চাপে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে আসার কারণে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন কর্মসংস্থানও হচ্ছে কম। সূত্র: সমকাল


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]