ইরানে বিয়ের আগে নারীদের সতীত্বের সনদ জোগাড় করতে হয়


আন্তর্জাতিক ডেস্ক : , আপডেট করা হয়েছে : 11-08-2022

ইরানে বিয়ের আগে নারীদের সতীত্বের সনদ জোগাড় করতে হয়

ইরানে বিয়ের আগে নারী এবং তার পরিবারের জন্য সতীত্ব বা কুমারীত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

এখনও অনেক পুরুষ বিয়ের আগে কনের সতীত্বের সার্টিফিকেট বা সনদ চায়, যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে, এমন পরীক্ষার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই এবং এটি নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন।

ইরানে গত কয়েক বছর ধরে বিয়ের আগে নারীদের সতীত্ব প্রমাণের এই পুরনো প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, প্রচারণা বাড়ছে।

"তুমি কুমারীত্ব হারিয়েছিলে বলেই আমাকে ফুঁসলিয়ে বিয়ে করেছো। তোমার আসলটা জানলে কেউই তোমাকে বিয়ে করতো না।"

বিয়ের পর প্রথম যৌনমিলনের পর মরিয়ামের স্বামী তাকে এই কথাই বলেছিল।

মারিয়াম তার স্বামীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে যে তার যোনিপথ দিয়ে রক্ত না বের হলেও বিয়ের আগে কখনই কারো সাথেই তার কোনো যৌনমিলন হয়নি।

কিন্তু স্বামী তাকে বিশ্বাস করেনি এবং প্রমাণ দেখাতে তাকে সতীত্বের সার্টিফিকেট আনতে বলে।

ইরানে এ ধরণের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাগদানের পর অনেক নারী ডাক্তারের কাছে গিয়ে কুমারীত্বের পরীক্ষা করায় যেন স্বামী কাছে প্রমাণ করতে পারে যে বিয়ের আগে তার কোনো যৌনমিলন হয়নি।

ডব্লিউএইচও বলে, এ ধরণের কুমারীত্ব পরীক্ষার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ পরীক্ষা দিয়ে যৌনমিলন নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

মারিয়ামের সতীত্বের সনদে লেখা ছিল যে তার হাইমেন বা যোনিপথের পর্দা অনেকটা ইলাস্টিকের মত। ফলে, যৌনমিলনের পরও তা ফেটে রক্তপাত হয়নি।

"পুরো বিষয়টি আমার সম্মানে খুব লাগে। আমি কোনো অন্যায় করিনি, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে দিনের পর দিন অপমান করেছে," বলেন মারিয়াম। "এক পর্যায়ে আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। একদিন ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি।"

সময়মত হাসাপাতালে নেওয়ার তার প্রাণ রক্ষা পায়।

"ঐ অন্ধকার দিনগুলোর কথা আমি ভুলবো না। কদিনে আমার ওজন ২০ কেজি কমে গিয়েছিল।"

অনেকে সোচ্চার হচ্ছে

মারিয়ামের এই কাহিনী ইরানের আর বহু নারীর মতই। অনেক নারী এবং তাদের পরিবারের জন্য বিয়ের আগে কুমারীত্ব প্রমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই রীতির শেঁকড় সেদেশের রক্ষণশীল সংস্কৃতির অনেক গভীরে প্রোথিত।

তবে সম্প্রতি হাওয়া ধীরে হলেও বদলাতে শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক নারী ও পুরুষ এ ধরণের সতীত্বের পরীক্ষা এবং সার্টিফিকেট নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।


গত নভেম্বরে অনলাইনে সতীত্ব পরীক্ষা নিষিদ্ধের একটি পিটিশনে এক মাসের মধ্যে ২৫,০০০ লোক সমর্থন জানায়। এই প্রথম ইরানে এত মানুষ এ ধরণের রীতি খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করলো।


"এই রীতি একজন নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং তার মর্যাদার লঙ্ঘন", বলেন নেদা।


তেহরানে তিনি যখন ১৭-বছরের ছাত্রী তখন এক ছেলে বন্ধুর সাথে তার প্রথম যৌনমিলন হয়। "পরপরই আমার ওপর আতংক ভর করে। পরিবার জানতে পারলে কী হবে এই ভেবে ভয়ে সিঁটকে গিয়েছিলাম।"

সুতরাং, নেদা অপারেশন করে তার যোনী-পর্দা জোড়া লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন।

যদিও এ ধরণের অপরেশন ইরানে নিষিদ্ধ নয়, তবে জানাজানি হলে তার ঝক্কির কথা ভেবে কোনো হাসপাতাল তা করতে রাজী হয়নি।

শেষে একটি বেসরকারি ক্লিনিক প্রচুর পয়সার বিনিময়ে গোপনে যোনী পর্দা জোড়া দেওয়ার ঐ অপারেশন করতে রাজী হয়।

"আমি আমার সব জমানো পয়সা খরচ করলাম। ল্যাপটপ বিক্রি করলাম। মোবাইল ফোন, গহনা সব বিক্রি করলাম," বলেন নেদা।

অপারেশনে কোনো ঝামেলা হলে তার সব দায় নেয়ার একটি মুচলেকায় সইও করেন নেদা।

একজন ধাত্রী ৪০ মিনিট ধরে অপারেশন করেন। সুস্থা হতে কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল তার।

"এত ব্যাথা হতো যে আমি পা নাড়াতে পারতাম না।"

"আমার ঐ পুরুষ বন্ধু আমাকে দোষারোপ করলো যে আমি তাকে ঠকাতে চেয়েছি। সে আমাকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিয়ে ছেড়ে চলে গেল।"

পরিবারের চাপ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে দিয়েছে এ ধরনের সতীত্বের পরীক্ষা শুধু যে অনৈতিক তা নায়, এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও ভিত্তিহীন। তারপরও ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান এবং তুরস্কসহ অনেক দেশে এমন পরীক্ষা এখনও প্রচলিত।

ইরানের চিকিৎসকদের সমিতি বলছে, মামলা বা ধর্ষণের অভিযোগের মত কিছু বিষয়ে তারা এ ধরণের পরীক্ষা করে।

কিন্তু কুমারীত্ব পরীক্ষা করে সার্টিফিকেটের চাহিদা আসে প্রধানত বিয়ের আগে দম্পতিদের কাছ থেকে।

মেয়েরা সাধারণত তাদের মায়েদের নিয়ে ক্লিনিকে হাজির হয়।

তারপর একজন গাইনির চিকিৎসক বা অনেক সময় একজন ধাত্রী নার্স যোনীপথ পরীক্ষা করে সনদ ইস্যু করেন।

সনদে ঐ মেয়ের নাম, তার বাবার নাম তার এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের বিস্তারিত থাকে। কখনো কখনো ছবিও থাকে।

সনদে তার যোনীপথের পর্দার অবস্থা বর্ণনা করে শেষ লেখা হয়,"খুব সম্ভবত এই নারী এখনও কুমারী।"

অতি রক্ষণশীল পরিবারের বেলায় এই সনদে দুইজন স্বাক্ষীর সই থাকে - সাধারণত পাত্রের মা ও পাত্রীর মা।

গত বেশ কবছর ধরে এ ধরনের কুমারীত্বের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন ড. ফারিবা। তিনি স্বীকার করেন একজন নারীর জন্য এই পরীক্ষা মর্যাদাহানীকর, কিন্তু একইসাথে তিনি মনে করেন এই পরীক্ষা করে অনেক নারীতে তিনি সাহায্য করছেন।

"মেয়েরা তাদের পরিবারের কাছ থেকে খুবই চাপের মধ্যে থাকে। আমি অনেক সময় মিথ্যা বলি। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক করেছে বুঝেও আমি দুই পরিবারকে বলি মেয়ে কুমারী।"

কিন্তু ইরানে অনেক পুরুষ এখনও কুমারী বা সতী নারী ছাড়া বিয়ের কথা ভাবতেই পারেনা। এ ব্যাপারে তারা আপোষহীন।

"যে নারী বিয়ের আগে সতীত্ব খুইয়েছে তাতে বিশ্বাস করা যায়না। সে তার স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে চলে যেতে পারে," বলেন ৩৪ বছরের আলী, সিরাজ শহরের একজন বিদ্যুৎ মিস্ত্রি।

তিনি স্বীকার করেন যে ১০টি নারীর সাথে তার যৌন সম্পর্ক হয়েছে। "আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।"

আলী স্বীকার করেন ইরানের সমাজে এ ধরণের নৈতিকতা একপেশে এবং গলদে ভর্তী, কিন্তু তিনি এই প্রচলিত প্রথা ভাঙতে নারাজ।

তার কথা - "সমাজই নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি স্বাধীনতা দিয়েছে। এটাই সমাজের প্রথা।"

ইরানে বহু মানুষই আলীর মত ভাবেন, বিশেষ করে রক্ষণশীল গ্রামীণ সমাজে।

যদিও বিয়ের আগে সতীত্ব পরীক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে, কিন্তু বিতর্কিত এই রীতি ইরানের সংস্কৃতির এত গভীরে প্রোথিত যে কেউই বিশ্বাস করেন না খুব সহসা সরকার বা পার্লামেন্ট আইন করে তা নিষিদ্ধ করবে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ

চার বছর ধরে স্বামীর গঞ্জনা-নির্যাতন সহ্য করার পর এবং আত্মহত্যা করতে গিয়ে প্রাণে বাঁচার পর মারিয়াম অবশেষে আইনি প্রক্রিয়ায় তালাক পেয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে।

"ভবিষ্যতে কেনো পুরুষকে বিশ্বাস করা আমার জন্য কঠিন হবে," বলেন তিনি, "অদূর ভবিষ্যতে আবারো বিয়ে কথার কথা আমি ভাবতেই পারিনা।"

অনলাইনে এ ধরনের সতীত্ব পরীক্ষা এবং সনদের প্রচলিত রীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে যে সব পিটিশন এখন হচ্ছে তাতে হাজার হাজার ইরানি নারীর মত তিনিও সই করেছেন।

যদিও মারিয়াম বিশ্বাস করেন না তার জীবদ্দশায় এই রীতি বন্ধ হবে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন ইরানের নারীরা আরো অধিকার পাবে।

"আমি নিশ্চিত একদিন এটা হবে। আমি আশা করি আমি যে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেয়েদের যেন তা ভোগ করতে না হয়।"

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য রিপোর্টে ব্যবহৃত নামগুলোর সবই ছদ্মনাম।

পুরো ঘটনা পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখে সে। "খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতাম। কিন্তু বাবা-মা স্বজনরা জানলে কী হবে এই ভয়ে ব্যাথ্যা সহ্য করতাম।"

কিন্তু এত কষ্ট দুর্ভোগের ফল সে পায়নি।

এক বছর পর এক ছেলের সাথে তার পরিচয় হয় যে তাকে বিয়ে করতে রাজী হয়। কিন্তু প্রথম যৌনমিলনের পর তার কোনো রক্তক্ষরণ হয়নি কারণ, যোনী-পর্দা জোড়া দেওয়ার অপারেশনে কাজ হয়নি।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]