ডাক্তারের বেশে সিরিয়াল কিলার !


আন্তর্জাতিক ডেস্ক: , আপডেট করা হয়েছে : 19-07-2022

ডাক্তারের বেশে সিরিয়াল কিলার !

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের ঘটনা। পরপর একাধিক খুন করার অপরাধে ধরা পড়েন একজন। একটা দুটো নয়, তাঁর মাথায় তখন ঝুলছে শতাধিক খুনের অভিযোগ। সাধারণ মানুষ থেকে প্রশাসন- সকলেই প্রশ্ন তুলছেন অপরাধীর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। কিন্তু চমকে ওঠার কারণ আরও ছিল। অবিশ্বাস্য শোনালেও এই নৃশংস অপরাধী ছিলেন পেশায় একজন ডাক্তার। ভিক্টিমেরা সকলেই মৃত্যুর আগে তাঁরই চিকিৎসাধীন ছিল। এই ঘটনার অন্তর্নিহিত অমানবিকতা সেসময় নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা ইউনাইটেড কিংডমকে। কেন তিনি একের পর এক খুন করে গেছেন নিজের অসহায় রোগীদের সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। মানুষের প্রাণ বাঁচানোই যে পেশার মূল কথা, সেই পেশায় থাকা একজন মানুষের এই রক্তলোলুপতা আজও আমাদের ভয় আর বিস্ময় ঘনিয়ে তোলে। সেই সিরিয়াল কিলার ডাক্তারের নাম হ্যারল্ড শিপম্যান।

১৯৪৬ সালের ১৫ জানুয়ারি নটিংহামের এক শ্রমজীবী পরিবারে হ্যারল্ডের জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন ট্রাক ড্রাইভার। কর্মসূত্রে গাড়ি নিয়ে ছুটে যেতে হত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, ফলে বছরের অর্ধেক দিনই তিনি থাকতেন বাড়ির বাইরে। পরিবারের প্রতি তাঁর টানও কম ছিল। তাই ছেলেবেলা থেকেই শিপম্যান বাবার ভালোবাসা কোনওদিনই সেভাবে পাননি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রমজীবী পরিবারের দৈনন্দিন সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই কেমন, তা ছোটবেলা থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিপম্যান। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ ছিল তার মা। মায়ের আদর ভালোবাসাতেই একটু একটু করে বেড়ে উঠেছিলেন ছোট্ট শিপম্যান। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই মাকেও ধরে রাখতে পারেননি। দুরারোগ্য অসুখ কেড়ে নেয় তাঁর মাকে। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মা ভেরা ভেট্রন যখন মারা যান তখন শিপম্যানের বয়স মাত্র সতেরো। জীবনের শেষ দিকে ভেরা ক্যান্সারের তীব্র যন্ত্রণা কমানোর জন্য দিনের পর দিন মরফিন ইঞ্জেকশন নিতেন। মায়ের শেষ দিনগুলোতে তাঁর পাশে থেকে হ্যারল্ড স্বচক্ষে দেখেছেন মায়ের প্রাণঘাতী কষ্ট আর তা লাঘবের জন্য ডাক্তারের নির্দেশে বারবার মরফিন ইঞ্জেকশন নেওয়া। তখন কে জানত এই ঘটনাই তীব্র রেখাপাত করে যাবে হ্যারল্ডের পরবর্তী জীবনে। 

ছোট্টবেলা থেকেই পড়াশোনা ও খেলাধুলায় রীতিমতো চাবুক ছিলেন হ্যারল্ড শিপম্যান। স্কুল জীবনে যুব রাগবি দলের সদস্য ছিলেন তিনি এবং স্কুল জীবনের শেষ বছরে তিনি স্কুলের অ্যাথলিট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। শারীরিক সক্ষমতায় সহপাঠীদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন হ্যারল্ড। ১৯৭০ সালে লিডস্ থেকে ডাক্তারি পাস করে ইয়র্কশায়ারে পোর্টফ্রেট জেনারেল ইনফরমারিতে কাজ শুরু করেন হ্যারল্ড।

আগেই বলেছি ছাত্র হিসেবে অসম্ভব মেধাবী ছিলেন হ্যারল্ড। ১৯৭৪ সালে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের আব্রাহাম অরমেরড মেডিক্যাল সেন্টারের জেনারেল প্রসিকিউটর (জিপি) হিসেবে প্রথম স্থান লাভ করে সবাইকে চমকে দেন তিনি। কিন্তু মায়ের মৃত্যু তাঁকে কিছুতেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দিচ্ছিল না। নানারকম অদ্ভুত গবেষণার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। এইরকমই একটা গবেষণার জন্য প্যাথিডিন নামে এক ধরনের নিষিদ্ধ ড্রাগ জোগাড় করতে গিয়ে প্রেসক্রিপশন জালিয়াতির কর্মকাণ্ডে ধরা পড়েন তিনি। বেশ মোটা টাকা জরিমানাও হয়। মানসিক অস্থিরতা কমাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় রিহ্যাবিলিটেশনে। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকার পর নিজেকে শুধরে আবার মূল পেশায় ফিরে আসেন হ্যারল্ড। আর এখান থেকেই মূল কাহিনির শুরু। (Harold Shipman)

নিজের অন্ধকার অতীত পেছনে ফেলে আশির দশকের শুরুতে হাইড শহরে ডাক্তারি চেম্বার সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন হ্যারল্ড। বাড়তে থাকে পশারও। কিন্তু ছেলেবেলার দিনগুলোর স্মৃতি প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খেত তাঁকে। মায়ের দীর্ঘ অসুস্থতা ও মৃত্যু, অর্থকষ্ট, প্রথম্ম শৈশবের স্নেহবঞ্চিত জীবন সবকিছুই ভয়ংকর ছায়া ফেলেছিল শিপম্যানের জীবনে। কিন্তু সেই মানসিক চাঞ্চল্য সাধারণের চোখে ধরা পড়ত না। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি ক্যামোফ্লেজ করে রাখতেন নিজেকে। আপাতভাবে সুস্থ আর সাফল্যময় এক জীবন। এমনকি সমাজে মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত তা নিয়ে ১৯৮৩ সাল নাগাদ টেলিভিশনে একখানি বক্তৃতাও দেন শিপম্যান, যা সেসময় গুণীমহলে রীতিমতো প্রশংসিত হয়। কিন্তু বাইরে আলোর কথা বললেও মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন এক অজানা প্রবৃত্তির অন্ধকার।

চেম্বারে বসার পর সবকিছু ভালই চলছিলো। রোগীদের ভিড়ও ছিল প্রচুর। ডাক্তার হিসেবে হাইড শহরে বেশ জাঁকিয়েই বসেছিলেন হ্যারল্ড। সেসময় হাইড শহরের ‘ফ্র্যাঙ্ক মেসি অ্যান্ড সন্স’ নামক এক সংস্থা ছিল, যেখানে মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখভাল করা হত। সংস্থার কর্ণধার ছিলেন ডক্টর লিন্ডা রেনল্ডস। কিছুদিন ধরেই একটা ব্যাপারে খটকা লাগছিল তাঁর। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, ইদানীং অন্ত্যেষ্টির জন্য যত মৃতদেহ আসছে তাদের মধ্যে হ্যারল্ড শিপম্যানের কাছ থেকে আসা মৃতদেহের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রথমে ব্যাপারটিকে বিশেষ গা করেননি তাঁরা। এটা হতেই পারে যে শহরের বিশিষ্ট ডাক্তারের কাছে রোগীর ভিড় যেমন বেশি, তেমনই কোনও কারণে তাঁর রোগীদের মধ্যে মৃতের সংখ্যাও বেশি। গোটা ব্যপারটাকেই প্রথমে ডক্টর লিন্ডা কাকতালীয় ভেবে উড়িয়ে দেন।
কিন্তু ব্যাপারটা দৃষ্টিকটূভাবে বেড়েই চলে। আরও একটা জিনিস লক্ষ করেন ডক্টর লিন্ডা।

তিনি দেখেন, যতজনের ক্রিমেশন ফর্ম সইসাবুদের জন্য ইদানীং তাঁর কাছে পাঠানো হয়, তাঁরা সবাই বৃদ্ধা এবং সবারই চিকিৎসা করেছেন ডক্টর হ্যারল্ড শিপম্যান। তিনি খেয়াল করে দেখেন কয়েক মাসের মধ্যে এরকম প্রায় ১০ জন বৃদ্ধার মৃতদেহের রিপোর্ট তাঁর কাছে জমা পড়েছে। এবার সন্দেহ কিছুটা দানা বাঁধে। এ ব্যপারে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন ডক্টর লিন্ডা। কিন্ত প্রথম প্রথম যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে হাত গুটিয়ে নেয় পুলিশ। নাম কা ওয়াস্তে কিছু রুটিন অনুসন্ধানের পর ১৯৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অবশ্য এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নন ডক্টর লিন্ডা। তাছাড়া তদন্ত বন্ধ হওয়ার পরপরই আরও তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তারা সকলেই বৃদ্ধা এবং দেখা যায় সকলেরই চিকিৎসা করেছেন ডক্টর শিপম্যান। মারা যাওয়া শেষ রোগীর নাম ছিল ক্যাথলিন গ্রান্ডি৷ মহিলার ডেথ সার্টিফিকেটে সই করার সময় স্পষ্ট কারণ না দেখিয়ে স্রেফ বয়সজনিত কারণেই গ্রান্ডির মৃত্যু হয়েছে বলে লিখে দেন শিপম্যান৷ এই ঘটনার পর আবার নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। সমালোচনার মুখে পড়ে প্রথমে অনভিজ্ঞ পুলিশকর্মীদের হাতে এই কেসটির দায়িত্বভার ছেড়ে রাখার সিদ্ধান্তটিও।

সন্দেহ প্রগাঢ় হয় যখন গ্রান্ডির মেয়ে অ্যাঞ্জেলা উডরাফ দেখেন যে তাঁর মা নিজের সমস্ত সম্পত্তিই ডাক্তার শিপম্যানের নামে লিখে দিয়ে গেছেন৷ সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম নয় তখনকার দিনের হিসেবে তিন লক্ষ ছিয়াশি হাজার পাউন্ড। উডরাফ পুলিশে রিপোর্ট করেন এবং ফের অনুসন্ধান শুরু হয়৷ তদন্ত করতে খোঁড়া হয় কবর। গ্রান্ডির শবদেহ বের করে ফের কাটাছেঁড়া করা হলে তাঁর শরীরে অত্যধিক পরিমাণে ডায়ামর্ফিন পাওয়া যায়৷ রাসায়নিকটির পুরো নাম ডায়ামরফিন হাইড্রোক্লোরাইড, যা কোনও বয়স্ক লোকের শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রবেশ করালে মৃত্যু অনিবার্য। মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুর রহস্য অনেকটা সহজ হয়ে আসে। ১৯৯৮-এর ৭ সেপ্টেম্বর শিপম্যানকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বাড়ি থেকে সম্পত্তির উইল জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত একখানি টাইপরাইটারও আবিষ্কৃত হয়।

পুলিশের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। গত কয়েক মাসে শিপম্যানের দাখিল করা ডেথ সার্টিফিকেটে নাম আছে এমন পনেরোটি মৃতদেহকে ফের কবর খুঁড়ে বের করে মর্গে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। ময়নাতদন্তের পর স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পনেরটি লাশের প্রত্যেকের শরীরেই বেশি মাত্রায় ডায়ামর্ফিনের প্রয়োগ হয়েছিল। শিপম্যান মারাত্মক রকমের বেশি ডায়ামর্ফিন রুগির শরীরে ঢুকিয়ে তাঁদের খুন করতেন এবং পরে মেডিক্যাল রিপোর্ট জাল করে নানা ধরনের অসুখের কারণ দেখিয়ে তাদের ডেথ সার্টিফিকেট দিতেনl। পুরো ব্যপারটাই সরকারি গোয়েন্দারের কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকেনা যে এই ১৫ টি মৃত্যুর পেছনে ডাক্তার শিপম্যানই দায়ী। কিন্তু কেন তিনি অকারণ এতগুলো নিরীহ মানুষকে খুন করলেন তার কোনও সদুত্তর সেভাবে পাওয়া যায়নি।

আপাত শান্ত স্বভাবের আড়ালে তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক অসুস্থ অপরাধমনস্কতা। মানসিক চিকিৎসকদের মতে, নিজের অত্যন্ত প্রিয় মানুষকে চোখের সামনে কষ্ট পেয়ে মারা যেতে দেখে এক অদ্ভুত রাগ তৈরি হয়েছিল হ্যারল্ডের মনে। নিজের মাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। কিন্তু মায়ের ওই মরফিন নিতে নিতে দগ্ধে দগ্ধে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার প্রতিশোধ নিতেই যেন আরও বেশি অপরাধপরায়ণ হয়ে ওঠেন তিনি। মা হারানোর যে যন্ত্রণা তিনি পেয়েছিলেন তা তিনি সেটাই যেন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সমাজের বুকে।

তখনকার দিনে প্রযুক্তি অত উন্নত ছিল না। হ্যারল্ডের অপরাধ হয়তো কোনওদিনই ধরা পড়ত না, যদি না তিনি টাকার লোভে উইলগুলো নিজের নামে করাতেন। এই উইল জাল করা নিয়ে দুটো তত্ত্ব খাড়া করেছিলেন প্রেসক্রিপশন ফর মার্ডার বইটির লেখকদ্বয়- ব্রায়ান হুটল্ এবং জাঁ রিচি। প্রথম তত্ত্বটি ছিল, টানা খুনখারাপির ফলে জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলেন শিপম্যান। ক্রমশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটি ক্ষীণ হয়ে আসছিল তার জীবনে। দ্বিতীয় তত্ত্বটি হয়তো অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য, সেই মত অনুসারে পঞ্চান্ন বছর বয়সে সবকিছু আত্মসাৎ করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে পালানোর মতলব এঁটে রেখেছিলেন তিনি।

১৯৯৯ সালের ৫ অক্টোবর সিরিয়াল কিলার শিপম্যানের বিচার শুরু হয়। মোট পনেরোটি খুনের দায় চাপানো হয় তাঁর ঘাড়ে। যদিও মনে করা হয়, তাঁর অসুস্থ মনের শিকার হয়েছিল প্রায় আড়াইশোর অধিক লোক। চমকাবেন না। ডায়ামর্ফিনের প্রয়োগ করে ঠিক এই সংখ্যক মানুষকেই তিনি খুন করেন বলে মনে করা হয়। জানা যায়, শিপম্যানের হাতে খুন হওয়া হতভাগ্যদের আশি শতাংশই মহিলা এবং সব চাইতে কম বয়সী ব্যক্তিটি, ঐ হাতে গোণা পুরুষদের একজন, যার বয়স ছিল একচল্লিশ। ২০০০ সালের ৩১ জানুয়ারি পনেরো জনকে হত্যা এবং ক্যাথলিন গ্রান্ডির উইল জাল করার দায়ে জুরি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত শিপম্যানকে পনেরোটি খুনের দায়ে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। আদালত তাদের রায়ে এমন ব্যবস্থা করে যেন শিপম্যান কখনোই ছাড়া না পায়। চার বছর জেল খাটার পর ২০০৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জেলখানাতেই আত্মহত্যা করেন শিপম্যান৷ এরপর থেকে ডাক্তারকে ভগবান ভাবার আগে একবার হ্যারল্ড শিপম্যানের কথা স্মরণ করতে ভুলবেন না।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]