প্রজাপতির সঙ্গে ‘অদ্ভুত’ সম্পর্ক, দেড় হাজার বছরের গাছ বাঁচাতে ৭৩৮ দিন গাছেই কাটান ইনি


এক্সক্লুসিভ: , আপডেট করা হয়েছে : 18-07-2022

প্রজাপতির সঙ্গে ‘অদ্ভুত’ সম্পর্ক, দেড় হাজার বছরের গাছ বাঁচাতে ৭৩৮ দিন গাছেই কাটান ইনি

পোশাকি নাম জুলিয়া লোরেন হিল। তবে নাম-পদবির মাঝখানের ‘লোরেন’কে হঠিয়ে তিনি তাতে ‘বাটারফ্লাই’ বসিয়ে দিয়েছেন। কারণ, আক্ষরিক অর্থেই তাঁর হাতে একটি প্রজাপতি বসেছিল। তখন তাঁর বয়স মোটে সাত!

এমনতর নানা ‘অদ্ভুত’ ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন আমেরিকার মিসৌরির বাসিন্দা জুলিয়া। সাত বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে এক দিনের একটি হাইকিং সফরে গিয়েছিলেন তিনি। সে সময় তাঁর হাতের আঙুলে একটি প্রজাপতি এসে বসে। গোটা সফরে সেটি নাকি সেখান থেকে নড়েনি। তার পর থেকেই মধ্যনামে ‘বাটারফ্লাই’ বসিয়ে দেন জুলিয়া। আজও তা সরাননি।

জুলিয়ার বয়স এখন ৪৮। তবে ২৩ বছর বয়সে তিনি এমন এক কাণ্ড করেছিলেন যা আজও তা ভোলেননি পরিবেশপ্রেমীরা।

সে সময় একটি প্রাচীন গাছ বাঁচাতে সেই গাছের মগডালে চড়ে বসেছিলেন জুলিয়া। তার পর তাতেই কাটিয়ে দেন একটানা ৭৩৮ দিন। বছর দুয়েকের বেশি পরে নিজের দাবিপূরণ করাতে বাধ্য করান আমেরিকার এক সংস্থাকে। সে কাহিনি শোনানোর আগে জুলিয়ার বেড়ে ওঠার গল্প জানা যাক! 

আরও অনেকের মতোই কেরিয়ার-সচেতন ছিলেন মিসৌরি প্রদেশের মাউন্ট ভার্নন শহরে বেড়ে ওঠা জুলিয়া। পড়াশোনার পাশাপাশি মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রোজগারের পথে নেমেছিলেন। সে সময় পরিবেশরক্ষার কথা ভাবার ফুরসত ছিল না তাঁর।

কম বয়স থেকেই অর্থ উপার্জনের নেশা পেয়ে বসেছিল জুলিয়াকে। ১৬ বছর বয়সে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। রেস্তরাঁয় খাবার পরিবেশন করা থেকে তার ম্যানেজারি— একটানা ছুটে চলেছিলেন জুলিয়া।

মিডল স্কুলে পড়ার সময় একটি দুর্ঘটনায় প্রায় মরতে বসেছিলেন ২২ বছরের জুলিয়া। ১৯৯৬ সালের অগস্টে আরকানসাসের রাস্তায় মত্ত বন্ধুর পাশে বসে তাঁর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সে সময়ই ওই পথ-দুর্ঘটনা ঘটে। পিছন থেকে সজোরে ধাক্কা মারে অন্য একটি গাড়ি। সে ধাক্কায় স্টিয়ারিং হুইলটি জুলিয়ার  মাথায় ঢুকে যায়।

ওই দুর্ঘটনার পর বছরখানেক কথা বলা বা হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন জুলিয়া। দীর্ঘ দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। তবে ওই দুর্ঘটনাটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

জুলিয়া বলেন, ‘‘সেরে ওঠার পর বুঝতে পারি, আমার গোটা জীবনের ভারসাম্যই তো বিগড়ে যাওয়া... হাই স্কুল থেকে পাশ করার পর ১৬ বছর বয়স থেকে একটানা রোজগার করে চলেছি। কেরিয়ার, সাফল্য আর সমস্ত পার্থিব বিষয়বস্তুর দিকেই ঝোঁক... ওই গাড়ি দুর্ঘটনা যেন আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল!’’

জুলিয়া আরও বলেন, ‘‘জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য বুঝিয়ে দিয়েছিল ওই গাড়ি দুর্ঘটনাটি। ভবিষ্যতে সদর্থক পদক্ষেপ করতে যা কিছু করতে পারি, তা-ই করার কথা ভেবেছিলাম। যে স্টিয়ারিং হুইলটা মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, তা যেন আমার জীবনকে নতুন পথে ঘুরিয়ে দিয়েছিল!’’

সুস্থ হয়ে ওঠার পর আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান শুরু করেছিলেন জুলিয়া। সে সময়ই কখন যেন ক্যালিফোর্নিয়ার হামবোল্ট কাউন্টিতে পরিবেশরক্ষার কাজে জড়িয়ে পড়েন।

ছিলেন জুলিয়া। সে সময় জঙ্গল বাঁচানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজও শুরু করেন। তিনি দেখেছিলেন, হামবোল্ট কাউন্টির রেডউড ফরেস্টে একটি বিশালকায় গাছের নীচে পালা করে বসছেন স্থানীয়েরা। উদ্দেশ্য— আমেরিকার প্যাসিফিক লাগার কোম্পানি (পিসিএল)-এর লোকজন যাতে ওই ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড গাছটিকে কেটে না ফেলেন!

সেরে উঠে একটি ‘রোড ট্রিপ’-এ গিয়েছিলেন জুলিয়া। সে সময় জঙ্গল বাঁচানোর জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজও শুরু করেন। তিনি দেখেছিলেন, হামবোল্ট কাউন্টির রেডউড ফরেস্টে একটি বিশালকায় গাছের নীচে পালা করে বসছেন স্থানীয়েরা। উদ্দেশ্য— আমেরিকার প্যাসিফিক লাগার কোম্পানি (পিসিএল)-এর লোকজন যাতে ওই ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড গাছটিকে কেটে না ফেলেন!

হামবোল্ট কাউন্টির ওই গাছটি স্টাফোর্ড এলাকাটিকে প্রায় ছেয়ে ফেলেছিল। অনেকের কাছেই সেটি ‘স্ট্যাফোর্ড জায়ান্ট’ বলে পরিচিত। বাসিন্দাদের দাবি ছিল, পিসিএল-এর যথেচ্ছ গাছ কাটার জেরেই এলাকায় ভূমিধস দেখা দিয়েছে। তাতে ১৭ ফুট কাদায় ডুবে গিয়েছে গোটা স্ট্যাফোর্ড এলাকাটি। সেটি ছিল ১৯৯৬ সাল।

১৮০ ফুট উঁচু প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো ওই গাছটি বাঁচাতে কোনও এক জনকে ওই গাছে স্থায়ী ভাবে বসানোর চিন্তা-ভাবনা চলছিল। জুলিয়া সে সময় কোনও পরিবেশরক্ষাকারী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে স্থানীয়দের স্বার্থে ওই গাছে তিনিই চড়ে বসেছিলেন।

১৯৯৭ সালের ১০ ডিসেম্বর স্ট্যাফোর্ড জায়ান্টে চড়েন জুলিয়া। তাঁর কথায়, ‘‘গাছে বসার জন্য আর কাউকে খুঁজে না পেয়ে আমাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল।’’ ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই গাছেই কাটিয়েছিলেন তিনি।

প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে জঙ্গলের পথে হেঁটে স্ট্যাফোর্ড জায়ান্টের কাছে পৌঁছেছিলেন জুলিয়া। ওই গাছটি আবার ‘লুনা’ বলেও পরিচিত। জুলিয়া গাছে চড়ার সময় রাতের আকাশে চাঁদ উঠছিল। ওই প্রতিবাদকে স্মরণীয় করে রাখতে সে সময় জুলিয়ার আশপাশে থাকা লোকজন ওই গাছটির নাম দিয়ে দেন ‘লুনা’। লাতিন ভাষায় চাঁদের নাম!

জুলিয়ার কথায়, ‘‘তখন মধ্যরাত। শেষমেশ একটি হুকের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ‘লুনা’য় চড়তে শুরু করেছিলাম। উপরে ওঠার সময় মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে গাছে চড়ছি।’’ 

ধরে ‘লুনা’য় ছ’ফুট বাই চার ফুট একটি কাঠের পাটাতনে বসবাস করেছিলেন জুলিয়া। তাতে থাকার নানা কায়দাও শিখে নিয়েছিলেন। একটি কুকারে রান্নাবান্না বা গাছের ডালেই ব্যায়াম করা অথবা সৌরশক্তিতে নিজের মোবাইল চালু রাখার পদ্ধতিও জেনে নিয়েছিলেন তিনি। স্লিপিং ব্যাগের সঙ্গে নিজেকে দড়িতে বেঁধে তাতেই ঘুমোতেন। জুলিয়াকে খাবার জোগান দেওয়ার আট সদস্যের একটি দলও ছিল।

গাছের ডালে বসেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন জুলিয়া। সেখান থেকেই টেলিভিশন শো করা বা প্রতিবাদে অংশ নেন তিনি। তাঁকে গাছ থেকে হঠানোর জন্য পিসিএল-এর তরফে হেলিকপ্টারে করে লোকজন পাঠানো হত বলেও অভিযোগ। তবে সে সবে দমেননি জুলিয়া।

লুনা’র আশপাশের ২০০ ফুট পর্যন্ত কোনও গাছ কাটা চলবে না। এর পর গাছ থেকে নেমে আসতে রাজি হন জুলিয়া। 

জুলিয়ার প্রতিবাদ চলাকালীন ৫০ হাজার ডলার (বর্তমান অর্থমূল্যে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা) চাঁদা তুলেছিলেন এই বিক্ষোভে শামিল পরিবেশকর্মীরা। সে টাকার পুরোটাই পিসিএল-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পিসিএল-এর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, গোটাটাই পরিবেশরক্ষার গবেষণায় হামবোল্ট স্টেট ইউনির্ভাসিটিকে দান করতে হবে।

ওই আন্দোলনের পর জুলিয়ার জীবনেও বদল এসেছে। এখনও পর্যন্ত আড়াইশোর বেশি ইভেন্টে পরিবেশরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন তিনি। লিখেছেন বেস্টসেলার বই। জড়িয়ে পড়েছেন বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে। ‘সার্কল অব লাইফ ফাউন্ডেশন’ নামে সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ার দাবি, পরিবেশ নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদল করাই লক্ষ্য তাঁর!


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]