শ্রেণী সংগ্রাম ও মে দিবস একসূত্রে গাঁথা


মোঃ কায়ছার আলী , আপডেট করা হয়েছে : 30-04-2022

শ্রেণী সংগ্রাম ও মে দিবস একসূত্রে গাঁথা

দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে, চোখ ফেটে এল জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল। যে দধীচিদের হাড় দিয়ে বাষ্পশকট চলে, বাবু সাব এসে চড়িল তাহাতে কুলিরা পড়িল তলে। মানবতা, সাম্যবাদী ও কালজয়ী  নজরুলের চোখের সামনে জীবনে কোন একদিন এরকম দৃশ্য পড়েছিল বলেই তিনি বাস্তববাদী কুলি-মজুর কবিতাখানি মানবজাতিকে উপহার দিতে পেরেছেন। যুগ যুগ ধরে কুলি মজুরের মত লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের ঘামে শ্রমে গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। তাই তিনি তাদেরই জয়গান গেয়েছেন। শ্রমজীবী মানুষেরা ধনিক শ্রেণীর কাছে সর্বদাই বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। তাদের শ্রমের বিনিময়ে স্বার্থান্বেষী হৃদয়হীন মানুষ বিত্তসম্পদের সবটুকুই ভোগ করছে অথচ মেহনতি জনতাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে নারাজ। সভ্যতার বিকাশে শ্রমিকের অবদান সবচেয়ে বেশি কিন্তু তারাই পায় না শ্রমের মর্যাদা। অবহেলায় কাটে তাদের দিন। প্রাপ্য মর্যাদাও জোটে না কখনো কখনো। জ্ঞানের রাজ্যে অবাধ বিচরণের বহু প্রতিভার অধিকারী অ্যারিস্টটল তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘ঞযব চড়ষরঃরপং’-এ কৃতদাস প্রথার উপর এক অবিস্মরণীয় বিচিত্র এক তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। যাকে দাসপ্রথা বলা হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে দাস প্রথা কালো অধ্যায় হয়ে রয়েছে। যুগে যুগে নিপীড়নের শিকার হয়েছে দাস-দাসীরা। তাদের দুভার্গোর গল্প গুলো বিবেকবান মানুষকে আজও স্তম্ভিত করে। সমাজে কিছু লোক আছে যারা প্রজ্ঞা ও মেধার অধিকারী এবং এ প্রজ্ঞার বলে শুধু তারা আদেশ প্রদানে সক্ষম পক্ষান্তরে বেশির ভাগ লোক আছে যারা দৈহিক বলে বলীয়ান এবং দৈহিক বলের কারণে তারা শুধু কায়িক পরিশ্রমে সক্ষম। তাদের মধ্যে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অভাব থাকায় তারা আদেশ প্রদানে অক্ষম। তাদের একমাত্র যোগ্যতা হল প্রজ্ঞাবাণের আদেশ মান্য করা এবং তদানুসারে কাজ করে যাওয়া। তাঁর মতে, “প্রথম শ্রেণীর লোকেরা হচ্ছে প্রভু এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা হচ্ছে দাস”। প্রভুরা যুক্তি বা আত্মার অধিকারী আর দাসরা লালসা বা দেহের অধিকারী। প্রভু ও দাসের মধ্যে সর্ম্পক হচ্ছে উত্তম ও অধমের সম্পর্ক। আড়াই হাজার বছর পূর্বেই তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আত্মার নিকট যেমন দেহ, বুদ্ধির নিকট ক্ষুধা, মানবের নিকট পশু, পুরুষের নিকট নারী, পিতার নিকট সন্তান অধীনস্থ ঠিক তেমনি বুদ্ধি বিবর্জিত মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন  মানুষের অধীনস্ত।’ আজও পৃথিবীতে সরাসরি দাস প্রথা না থাকলেও সর্বত্র শাসক ও শোষিত শ্রেণী এ আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির যুগেও বিদ্যমান। আজ ১লা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের মর্যাদাকে সম্মুন্নত রাখার দিবস। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যান্ডের সমাজ বিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন সর্বপ্রথম শ্রমিকদের আট ঘন্টা শ্রম, আট ঘন্টা মনোরঞ্জন এবং আট ঘন্টা বিশ্রামের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়ন আর অধিক মুনাফার জন্য শিল্প মালিকেরা শ্রমিকদের কাজের কোন সময় বেঁধে দিতে রাজি ছিলেন না। মালিকদের ইচ্ছা মত শ্রমিকদের কাজ করতে হত। শ্রমিকদের দৈনিক কর্মবন্টনের কোন নীতিমালা ছিল না। ১৮৮৪ সালের ৭ই অক্টোবর আমেরিকা ফেডারেশন অব লেবার দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার দাবি তোলেন। এই দাবি ক্রমশ জোরদার হলেও মালিক পক্ষ কোন কর্ণপাত করেন না। ১৮৮৬ সালের ১লা মে শ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শ্রমিক মিশিগান এভিনিউ এর মিছিলে যোগদানের প্রস্তুতি নিলে মালিকপক্ষ ভয় পেয়ে পুলিশ বাহিনীকে জড়ো করেন। ৩ ও ৪ মে ধর্মঘট আরো ব্যাপক সাফল্য লাভ করলে পুলিশ শ্রমিক সমাবেশে গুলি চালায়। গুলিতে ১০জন শ্রমিক নিহত, বহু আহত এবং গ্রেফতার হয়। ৪ মে শিকাগোর ‘হে’ মার্কেট চত্তরে বিশাল সমাবেশ কে বা কারা বোমা ফাটালে পুলির বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ করে। এক কিশোর শ্রমিক তখন তার গায়ের জামা খুলে রক্তে ভিজিয়ে লাল জামাটি উড়িয়ে দেয় পতাকা হিসেবে। আজও পৃথিবীতে শ্রমিকদের পতাকাটি সেই কিশোরের রক্তে লালে লাল। আটকৃতদের মধ্যে অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়। ১৮৮৭ সালে ৪ জন বিপ্লবী শ্রমিক যথাক্রমে এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স ও স্পাইসকে ফাঁসি দেওয়া হয়। মৃত্যুঞ্জয়ী  বিপ্লবী শ্রমিকেরা সে সময় শ্রমিকদের অধিকারের কথা নিয়ে রচিত গণসঙ্গীত ও বিপ্লবী গান গেয়ে যায়। ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্ব মুহুর্তে স্পাইস বলে যান, “এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা (মৃত্যু) তোমরা যে কন্ঠকে স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।’ বৃথা যায়নি সংশপ্তক শ্রমিক নেতা স্পাইসের গর্জন। বিশ্বে আজ শ্রমিকদের আট ঘন্টা শ্রমের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে দেশে ১লা মে স্মরণ করা হচ্ছে ‘হে’ মার্কেটের বিপ্লবী মহান শ্রমিকদের। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টি দেশে আজ ছুটির দিন। যেসব দেশে ছুটির দিন নয়, সেসব দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিবসটি পালিত হচ্ছে। মে দিবসকে মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করতে হলে আদিকালের শ্রমব্যবস্থা বা দাসপ্রথা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা থাকা প্রয়োজন। দাস প্রথা শুরু হয় ব্যাবিলন, গ্রীক এবং রোম থেকে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ নিদর্শন মিলে। সমাজের বর্বর অবস্থায় এর বীজ বিকশিত হয়েছিল এবং জড়বাদী সভ্যতায় এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও এর সমৃদ্ধি অব্যহত ছিল। শ্রমিকদের জীবনযাত্রা ছিল দুঃখ কষ্ট-ঘৃণিত এবং চরম অবহেলিত। সূর্যোদয় থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরামহীন শ্রম দামে এমনকি অমানবিক বেত্রাঘাতের মাধ্যমে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হত। ঐতিহাসিক যুগে শ্রেণীসংগ্রাম শুরু হয় সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ২০৫০ সালে অর্থ্যাৎ আজ থেকে ৪১৭১ বছর আগে এবং অবসান হয় খ্রিস্টপূর্ব ২১৫০ সালে। দীর্ঘ একশ বছর রক্তাক্ত শ্রেণীসংগ্রামের কাহিনী প্যাপিরাস এর পাতে লিখিত সেই কাহিনীর মধ্য দিয়ে সেই যুগে মিশরের শ্রেণী নির্যাতন ও শ্রেণী সংগ্রামের জ্বলন্ত নিদর্শন দেখতে পাই। প্রাচীন মিশরের কৃষকদের দুরাবস্থার  কথা বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক লিপিকার লিখেছেন, ক্ষেত্রের আধা ফসল খেয়ে ফেলেছে পোকায়, কিছু গেছে হিপ্পে পোটে মাসের পেটে, ফসলের ক্ষেত্রে ইঁদুরের দংগল, পঙ্গপালের দলও এসে পড়েছে, গরু বাছুর ফসলের ক্ষেতে ঢুকে পড়েছে, চড়–ইর দল ফসল  চুরি করে খায়, গোলায় যা কিছু সঞ্চিত ছিল তাও গিয়ে পড়ে চোরদের হাতে। লাঙ্গল চষতে চষতে আর ফসল মাড়াই করতে করতে বলদগুলো অতিরিক্ত পরিশ্রমে মারা যায়। এর পরেও সরকারের লোকেরা আসে তাদের প্রাপ্য ফসল আদায় করে নিতে। হায়রে চাষী, সরকারি কর্মচারীদের হাতে ছড়ি, সাথে আছে নিগ্রো অনুচর, হাতে তাদের ভন্ড। তাদের দেরী সয় না, হেঁকে উঠে, দিয়ে দে আমাদের পাওনা ফসল। যেই কৃষকদের কাছে ফসল নাই, তাদের ধরে তারা বেদম প্রহার করে। শুধু কি তাই? তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে তারা খালের পানিতে ফেলে দেয় আর তারা ডুবতে থাকে। এই ভাবে তারা বউ, ছেলে ও মেয়েদেরও  বাঁধে। ফারাও আর তার দল বল অন্যান্য শ্রমিকদের সাথেও এ ধরনের অমানবিক আচরণ করত। রোমান সা¤্রাজ্য ধ্বংস হলে দাসপ্রথা লোপ পায় এবং দাসেরা স্বাধীন হয়ে ভূমিদাস ও স্বাধীন প্রজায় পরিণত হয়। মধ্যযুগের শেষ দিকে ১৪ শতকে ইউরোপের দেশে দেশে কৃষক বিদ্রোহ ঘটতে থাকে। ১৩৫৮ সালে ফ্রান্সের কৃষকরা বিদ্রোহ করে। এ সময় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে শত বছরের যুদ্ধ চলছিল কিন্তু যুদ্ধ স্থগিত রেখে ইংরেজ সৈন্যরা ফরাসি জমিদারদের এ বিদ্রোহ দমনে সহায়তা করে এবং বিশ হাজার কৃষককে হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করে। ১৩৮১ সালে ওয়াট টাইলর নামে এক কারিগর এর নেতৃত্বে কৃষকরা দল বেঁধে লন্ডন শহর আক্রমণ করলে রাজা লন্ডনের দুর্গে আশ্রয় নেন। প্রজাদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আলোচনারত অবস্থায় ওয়াট টাইলরকে হত্যা করে কৃষক বিদ্রোহ দমন করেন। ১৪১৯ সালে জার্মানিতে কৃষক বিদ্রোহ নেতৃত্বে দেন ইয়ান সান। তাঁকেও আলোচনার কথা বলে হত্যা করা হয়। ১৫ বছর ধরে চলা কৃষকবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত দমিত হয়। এই দেশেও কৃষকদের নির্যাতনের  (তেভাগা আন্দোলন) ঘটনা ঘটেছে। সেই বিখ্যাত কবিতা খানি আজও ইতিহাস স্বাক্ষ্য বহন করে “খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিবো কি সে? ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কি? আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি। শ্রমিকদের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলে মানুষের বিবেকের জয় হয়েছে। মেহনতি মানুষের আন্দোলন কখনও ছিল তীব্র ও ব্যাপক, কখনো ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ, কখনো সরল ও কখনো জটিল, কখনো প্রকাশ্য, কখনো ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ, কখনো সরল ও কখনো জটিল, কখনো প্রকাশ্য, কখনো বা প্রচ্ছন্ন ভাবে আবর্তিত হয়ে চলে। শ্রমিকেরা নিঃস্ব হতে হতে এবং মালিকেরা শোষণ করতে করতে পুঁজিবাদী বা ধনতন্ত্রের সূত্রপাত হয়। ইউরোপের প্রথম ধনতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয় হল্যান্ডে, ১৭ শতকে ইংল্যান্ডে, ১৮ শতকে ফ্রান্সে। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা সরকারের সবরকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করত আর কৃষক, মেহনতি জনতা ও জনসাধারণ সরকারের দ্বারা শোষিত হত। অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা কোন কর দিত না আবার বণিক শ্রেণী অনেক ধন সম্পত্তি অর্জন করলেও তারা কখনও প্রাধান্য পেতনা। বণিক কারিগর কৃষকদের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ ফরাসি বিপ্লবে পরিণত হয়। রক্তের মাধ্যমে অর্জিত শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হয়। দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই কর। শ্রমিকের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এ শ্লোগান চিরজাগ্রত হোক। আজও যারা শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে দিনানিপাত করছেন তাদের শরীরের পবিত্র ঘাম শুকানোর পূর্বেই বা ক্লান্তি থাকতে থাকতে অথবা পায়ে, কাঁধে, পিঠে, মাথায়, বাহুতে, হাতের তালুতে দাগ ধুয়ে বা মুছে ফেলার আগেই শ্রমিকদের নায্য মজুরী প্রদানের জন্য সকলের নিকট অনুরোধ করছি। 

 লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট 


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]