গুম কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ; ঠোঁট সেলাই, বৈদ্যুতিক শক মাথায় গুলি করে হত্যা !


অনলাইন ডেস্ক : , আপডেট করা হয়েছে : 16-12-2024

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ; ঠোঁট সেলাই, বৈদ্যুতিক শক মাথায় গুলি করে হত্যা !

গুমের পর হত্যা। কখনো অমানুষিক নির্যাতন আবার কখনো হত্যা করা হয়েছে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরপর অধিকাংশ লাশ সিমেন্টে বেঁধে নদীতে ফেলা হয়েছে। আবার কখনো রেললাইনে ফেলে রেখে লাশ বিচ্ছিন্ন করতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা হয়েছে। সুস্থ মানুষের ঠোঁট সেলাই করা এবং যৌনাঙ্গসহ স্পর্শকাতর জায়গায় দেওয়া হয়েছে বৈদ্যুতিক শক। কোনো সিনেমার কাহিনী নয়, লোমহর্ষক এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে শনিবার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী। 

রোববার প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গা শিহরে ওঠার মতো তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে কমিশন। 

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের এক হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি। অভিযোগের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিটি অভিযোগে অন্তত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকায় এসব ঘটনাকে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে কমিশন। সেগুলো হলো- ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা কর্তৃপক্ষের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে তার পরিবার বা সমাজকে না জানানো এবং ভুক্তভোগীকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেয়া। অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা ও মুক্তি এই পাঁচটি ভাগে সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল উপায়ে গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদনে, ঘটনায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। গুম হওয়া বেশির ভাগ ব্যক্তিকে হয় হত্যা করা হয়েছে অথবা মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এতে বলা হয়, কমিশন গুমের পর মেরে ফেলার পদ্ধতি সম্পর্কে যাচাইকৃত বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। একটি কার্যকর পদ্ধতি হলো মাথায় গুলি করা। এরপর মরদেহ সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে  দেওয়া হয়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘র‌্যাবে কর্মরত সামরিক কর্মকর্তারা এই পদ্ধতিকে মরদেহ ডুবিয়ে  দেওয়ার আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।’ হত্যার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদী, শীতলক্ষ্যা নদী (কাঞ্চন সেতু) এবং পোস্তগোলা সেতুর কাছাকাছি এলাকার কথা উল্লে­খ আছে। সুন্দরবনের জলদস্যুদের কাছ থেকে জব্দ করা একটি নৌকার কথা উল্লে­খ আছে প্রতিবেদনে। এটি পোস্তগোলা সেতুর কাছে রাখা হয়েছিল। 

প্রতিবেদনে র‌্যাবের এক ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। তার বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, র‌্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান পরিচালিত একটি সেশনে ‘র‌্যাবে ঢোকার অংশ হিসেবে’ একটি সেতুতে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগে নিযুক্ত আরেক সৈনিকের বরাতে এতে বলা হয়, এক ভুক্তভোগী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাকে নদী থেকে উঠিয়ে আনা হয় এবং পরে ঘটনাস্থলেই হত্যা করা হয়।

টার্গেট নির্বাচন, নজরদারি ও অপহরণ : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাউকে গুম করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। অনেক সময় প্রথমে কাউকে আটক করে নির্যাতন করে অন্যদের নাম আদায় করা হতো। এরপর তাদেরও ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। পরে এদের সবাইকে গুম করা হতো। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সরাসরি নির্দেশেও গুম ও নির্যাতন করা হতো।

উদাহরণ হিসাবে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার সময় তৎকালীন র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদের স্বীকারোক্তির কথা তুলে ধরা হয়েছে। গুমের ক্ষেত্রে ভিকটিমদের অবস্থান চিহ্নিত করতে মোবাইল প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হতো বলে উল্লে­খ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) এবং পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইল নজরদারি পরিচালনা করেছে। এরপর টার্গেট করা ব্যক্তিকে অপহরণ করা হতো। 

অপহরণকারীরা নিজেদের ‘প্রশাসনের লোক’ বা আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সদস্য হিসাবে পরিচয় দিতেন বলে তদন্তে দেখতে পেয়েছে কমিশন। সাধারণত সাদা পোশাকে ভুক্তভোগীদের তুলে নেওয়া হতো এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করার জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থার নাম ব্যবহার করত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, অপহরণের ঘটনা ঘটত সাধারণত রাতে। ভিকটিমের বাড়ি বা রাস্তা থেকে তাদের জোরপূর্বক বড় গাড়িতে তুলে নেওয়া হতো। গাড়িতে তোলার পরপরই ভিকটিমদের চোখ বাঁধা হতো এবং হাতকড়া পরানো হতো। অপহরণের পুরো ঘটনাটি এতটাই দ্রুত ঘটত যে, আশপাশে থাকা মানুষ বুঝতেও পারত না যে কাউকে অপহরণ করা হয়েছে।

আটক ও নির্যাতন : আটক করার পর ভুক্তভোগীদের সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো। সেখানেই তাদের ওপর চালানো হতো নানা ধরনের নির্যাতন। আটকের সময়কাল কখনো ৪৮ ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত ছিল। এমন কয়েকজন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কমিশন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এমন আটটি গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিচালনা করত।

কমিশন ইতোমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অফিস পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে র‌্যাব ইউনিট, ডিবি সদর দপ্তর এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অফিস। এসব আটককেন্দ্রের মধ্যে কাঠামোগত মিল পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। এ ধরনের মিল থেকে কমিশন ধারণা করছে পুরো বিষয়টি কোনো একটি কেন্দ্র থেকে পরিকল্পনা ও তদারকি করা হতো। 

কমিশনের তদন্তে বলা হয়েছে, কিছু কারাগার এখনো অক্ষত রয়েছে। অনেকগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। আটক অবস্থায় ভুক্তভোগীদের ওপর নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। কিছু নির্যাতনের ধরন ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ, যেমন পেটানো, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া। কমিশন দুটি নির্যাতনের উদাহরণ দিয়েছে। ২০১০ সালে, ঢাকার ধানমন্ডি থেকে র‌্যাব এক যুবককে অপহরণ করে কোনো অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া ঠোঁট সেলাই করে দেয়। আরেক ভুক্তভোগীর ওপর নানা শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়, বিশেষ করে তার কানে ও যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। গুমের শিকারদের বেশির ভাগ সময় হয় মেরে ফেলা হতো, না হলে অপরাধী হিসাবে বিচারব্যবস্থায় সোপর্দ করা হতো। আবার অনেক ভিকটিমকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হতো। গুমের শিকার অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিকটিমদের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হতো। এরপর মৃতদেহ সিমেন্টের ব্যাগের সঙ্গে বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো যেন মৃতদেহ ডুবে যায়। যেসব নদীতে এসব লাশ গুম করা হতো, তার মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদী। সেজন্য কাঞ্চন ব্রিজ ও পোস্তগোলা ব্রিজ ব্যবহার করা হতো। 

মৌখিক সাক্ষীর বরাতে কমিশন জানিয়েছে, র‌্যাবের একটি ‘ওরিয়েন্টেশন’ সেশনে তাকে দুজন ভিকটিমকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেখানো হয়েছিল। এক সেনা সদস্য, যিনি র‌্যাবের  গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলেন, তার বরাতে গুম কমিশন জানিয়েছে, এক ভুক্তভোগী নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাকে উদ্ধারের পর, সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়।

আরেকটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে, এক কর্মকর্তা জানান, তাকে একটি লাশ নিয়ে ঢাকার রেললাইনের ওপর রেখে ট্রেনের অপেক্ষা করতে বলা হয় যেন ট্রেনের চাপায় লাশটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি আরেক ভুক্তভোগীকে সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে  ফেলে দেওয়া হলেও গাড়িটি পাশ কেটে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। গুমের ঘটনাগুলো বিভিন্ন বাহিনী আলাদাভাবে ও সুসংগঠিত উপায়ে পরিচালনা করত বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। অর্থাৎ, এক দল অপহরণ করলে, অন্য দল আটকের কাজ করত এবং তৃতীয় দল হত্যা বা মুক্তি দিত। অনেক সময় যারা এসব কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা জানতেনও না তারা কাকে এবং কেন হত্যা বা নির্যাতন করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব কিছুর পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল ভিকটিমদের নির্মূল করা এবং লাশ এমনভাবে সরানো যেন সেগুলো পুনরুদ্ধার বা শনাক্ত করা না যায়। তবে যারা গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন তাদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আরও নানা তথ্য মিলেছে। 

কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গুমের শিকারদের মধ্যে ৭৩% আবার জীবিত ফিরে এসেছেন। তবে ২৭% এখনো নিখোঁজ। ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের অনেকে জানিয়েছেন, গুম নির্যাতন ও বন্দি রাখার পর তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মধ্যে রয়েছে : সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্র আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে বিভিন্ন মামলা। আবার গণমাধ্যমে নেতিবাচক খবরের কারণে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার সমাজে চরম অবমাননার শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লে­খ করা হয়। কমিশন বর্তমানে এই বিষয়গুলোর ওপর গভীর তদন্ত ও সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কথা জানিয়েছে। যা ভবিষ্যতে আরও বিস্তারিত আকারে প্রকাশ করা হবে। 

কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে বেশির ভাগ গুমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংস্থার নিম্নপদস্থ লোকজন জানতেন না, তারা কাকে আটক করেছে বা কেন করেছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জানান পুরো অপারেশন তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়েছে। দেশের এবং আন্তর্জাতিক আইনে এক্ষেত্রে শাস্তির বিধান থাকলেও অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়ে জবাবদিহিতা এড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লে­খ করা হয়। বাংলাদেশে গুমের ঘটনা শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ। বিশেষ করে ভারতীয়দের জড়িত থাকার কথা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সুখরঞ্জন বালি এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী তার বন্দিশালায় হিন্দি ভাষাভাষী লোকদের কথা শোনার কথা কমিশনকে জানিয়েছেন। তার দাবি মুক্তির সময় তাকে বলা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন, তবে কিছু শর্ত রয়েছে। আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হবে, দেশ ত্যাগ করতে হবে।’ অন্যদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদকে ২০১৫ সালে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]