আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করল চিন্ময়ের অনুসারীরা


অনলাইন ডেস্ক : , আপডেট করা হয়েছে : 27-11-2024

আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করল চিন্ময়ের অনুসারীরা

চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনা সংঘের (ইসকন) নেতা ও সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ প্রভু ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার ও তার জামিন নামঞ্জুরের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।

সনাতনী সমাজ চট্টগ্রাম আদালত ভবনে চিন্ময় প্রভুকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান দুই ঘন্টারও বেশি সময় আটকে রেখে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় পুলিশ তাদের সরাতে গেলে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ টিয়ার সেল নিক্ষেপ, ফাঁকা গুলি বর্ষণ ও লাঠি চার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় বিজিবিও।

সংঘর্ষ চলাকালে আদালত ভবন চত্বর, জেলা পরিষদ মার্কেট, কোতোয়ালী, টেরিবাজার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় বেশ কিছু যানবাহন ভাংচুর করা হয়। সংঘর্ষ চলাকালে সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে এবং ৮ জনকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এদিকে সন্ধ্যা ছয়টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় নিউ মার্কেট চত্বরে কিছু সমন্বয়য়কের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা ও সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন পাল্টাপাল্টি অবস্থন নেয়। মাঝখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নিয়ে দুই পক্ষকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। বিরাজ করে থমথমে পরিস্থিতি।

সোমবার রাতে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও সনাতনী সম্প্রদায় বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল বের করে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় চিন্ময় প্রভুকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম আদালতে তোলা হয়। ১১টা ৭ মিনিটের দিকে তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় আদালত প্রাঙ্গন জুড়ে পুলিশসহ যৌথবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তাবলয় ছিল। বেলা ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (৬ষ্ঠ) কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় কয়েকজন আইনজীবীকে চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আদালতে তার জামিন শুনানি শুরু করেন। আদালতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সনাতনী সম্প্রদায়ের কয়েকশ আইনজীবী আদালতের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করেন। আদালত আবেদনের শুনানি শেষে তার জামিন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিন্ময় কৃষ্ণকে কারাগারে ডিভিশন ও ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।

আসামী পক্ষের আইনজীবী স্বরূপ কান্তি নাথ বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আদালত চিন্ময় প্রভুর জামিন নামঞ্জুর করেছেন। উনাকে কারাগারে ডিভিশন সুবিধা দেওয়ার জন্য আদালত আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া আমাদের আরেকটা আবেদন ছিল। উনি যেহেতু নিরামিষভোজী ও শাকাহারি, উনাকে যেন ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়। আদালত সেটা মঞ্জুর করে কারা কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

এই আইনজীবী বলেন, তারা নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে বুধবার রিভিশন করবেন। সেখানে আবার জামিন চাইবেন।

সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে

এদিকে জামিন নামঞ্জুরের খবর শুনে আদালত চত্বরে অবস্থানরত সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে চিন্ময় প্রভুকে আদালত থেকে বের করে কারাগারে নেওয়ার জন্য প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। তখন সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন প্রিজন ভ্যানের সামনে পেছনে অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। কেউ কেউ প্রিজন ভ্যানের সামনে শুয়ে পড়েন। তারা চিন্ময়ের মুক্তির দাবিতে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। তাকে কারাগারে নিতে বাধা দেন। এভাবে প্রায় আড়াই ঘন্টা বিক্ষোভ চলে। বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য প্রিজন ভ্যানের ভেতর থাকা চিন্ময় প্রভুর সামনে বাইরে থেকে হ্যান্ডমাইক দেওয়া হয়। ভেতর থেকেই বক্তব্য দেন। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার ও ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়, এমন কোনো কর্মকাণ্ড না করার আহ্বান জানান ভক্তদের উদ্দেশে। তবে এতেও শান্ত হচ্ছিলেন না তারা। তার আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, সনাতনীদের দমানোর জন্যই চিন্ময় প্রভুকে মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় জড়ানো হয়েছে।

আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা

সিএমপির উর্ধ্বতন কর্মকর্তরাও আন্দোলনরতদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। বিকাল তিনটার পর পুলিশ, বিজিবি ও এপিবিএন বিক্ষোভকারীদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। বিক্ষোভকারীরাও আদালত চত্বরে থাকা প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন ভাংচুর করতে থাকে। বিকাল ৩টার দিকে প্রিজন ভ্যান কারাগারের উদ্দেশে এগোতে থাকে। পথে-পথে চিন্ময়ের অনুসারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। জেলা পরিষদের সামনের সড়ক অবরোধ করে যানবাহন ভাংচুর শুরু করলে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নিক্ষেপ করতে থাকে ইটপাটকেল। আদালত ভবনের মসজিদের জানালার কাচ ভাংচুর করা হয়।

এতে ক্ষুব্দ আইনজীবীরা একত্রিত হয়ে সনাতনীদের ধাওয়া দিয়ে রঙ্গম সিনেমার গলিতে ঢুকিয়ে দেয়। সেখানে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবীর ওপর হামলা করে সনাতনীরা। তাকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পুলিশ ও অন্যান্য আইনজীবীরা তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বেলা বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে সনাতনী, পুলিশ সাধারণ আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীসহ অর্ধ-শতাধিক মানুষ আহত হন। এর মধ্যে ১৯ জনকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮ জনকে ভর্তির তথ্য পাওয়া গেছে।

সিএমপির এডিসি (প্রসিকিউশন) হুমায়ুন কবীর যুগান্তরকে বলেন, সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন দুই ঘন্টারও বেশি সময় ধরে প্রিজন ভ্যান আটকে রেখেছিল। কোনোভাবেই তাকে কারাগারে নিতে দিচ্ছিলেন না। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিচার্জ ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। তারাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা করে। পুলিশের পাশপাশি আদালত চত্বরে ৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছিল।

চিন্ময় কৃষ্ণ প্রভুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে আগে থেকেই নিউমার্কেট চত্বরে মঙ্গলবার সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে সনাতনীরা। আদালত ভবনের বিক্ষোভ শেষে তারা নিউমার্কেট চত্বরে অবস্থান নেয়। একইভাবে আইনজীবী হত্যা ও হামলার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কসহ ছাত্র-জনতা অবস্থান নেয় নিউমার্কেটে। এ সময় পুলিশ দুই পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। বিকালে পাথরঘাটা গঙ্গা বাড়ি, সেবক কলোনীসহ আশপাশের এলাকায় পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ হয়।

নিহত আইনজীবীর পরিচয়

সনাতনীদের হামলায় নিহত আইনজীবীর নাম সাইফুল ইসলাম আলিফ। তার বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের পানত্রিশা গ্রামে। ২০১৮ সালে তিনি জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০২৩ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকা ভুক্ত হন। আইনজীবী শাপালা ভবনের ৩৩১ নম্বর চেম্বারে বসতেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার লাশ ঘিরে সহকর্মী আইনজীবীরা বিক্ষোভ করেন। তারা সাইফুল হত্যার জন্য ইসকনকে দায়ী কারে তাদের শাস্তি দাবি করেন।

আইনজীবীদের কোর্ট বর্জন

আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে বুধবার আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সহকর্মীর লাশ দেখার পর তিনি এ কর্মসূচি ঘোষণা সমিতির সাধারল সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফুল ইসলাম রাজ্জাক।

তিনি বলেন, আদালত থেকে যাওয়ার পথে সনাতনীরা বেপরোয়া হামলা করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে, মসজিদের গ্যাস ভাঙচুর করেছে। তাদের হামলায় আমাদের একজন আইনজীবী নিহত হয়েছেন। তাকে ধরে মেথরপট্টিতে নিয়ে গিয়ে কুপিয়েছে ইস্কনের সন্ত্রাসীরা। এটার জন্য আমরা সমিতির পক্ষ থেকে জরুরি মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মহানগর দায়রা জজ, জেলা দায়রা জজ, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সকল আদালতের কার্যক্রম আমরা সাসপেন্ড ঘোষণা করছি।

যে মামলায় গ্রেফতার চিন্ময়

ফিরোজ খান নামে এক ব্যক্তি গত ৩০ অক্টোবর চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা এ মামলায় জাতীয় পতাকা অবমাননা তথা রাষ্ট্র্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৫ অগাস্ট গণঅভুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা নিউমার্কেট মোড়ে একটি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। গত ২৫ অক্টোবর লালদিঘী মোড়ে সমাবেশের দিন ওই পতাকার ওপর সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় গোষ্ঠী ইসকনের গেরুয়া রঙের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে স্থাপন করে দেওয়া হয়, যা রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে অস্বীকার করার সামিল। এজাহারে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার ওপর ধর্মীয় পাতাকা উত্তোলন করে আসামিরা দেশের ভেতর অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রদ্রোহ কাজে লিপ্ত আছে। দণ্ডবিধির ১২০ (খ), ১২৪ (ক), ১৫৩ (ক), ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছে।

ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও পুণ্ডরীক ধাম মন্দিরের অধ্যক্ষ চন্দন কুমার ধর প্রকাশ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভু ব্রহ্মচারী ছাড়াও চট্টগ্রামের হিন্দু জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক অজয় দত্ত (৩৪), নগরীর পবর্তক ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলা রাজ দাশ ব্রহ্মচারী (৪৮), গোপাল দাশ টিপু (৩৮), ডা. কথক দাশ (৪০), প্রকৌশলী অমিত ধর (৩৮), রনি দাশ (৩৮), রাজীব দাশ (৩২), কৃষ্ণ কুমার দত্ত (৫২), জিকু চৌধুরী (৪০), নিউটন দে ববি (৩৮), তুষার চক্রবর্তী রাজীব (২৮), মিথুন দে (৩৫), রূপন ধর (৩৫), রিমন দত্ত (২৮), সুকান্ত দাশ (২৮), বিশ্বজিৎ গুপ্ত (৪২), রাজেশ চৌধুরী (২৮) এবং হৃদয় দাসকে (২৫) আসামি করা হয়।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]