হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথি আর ইরানের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যেই রণাঙ্গনে ‘আয়রন বিম নিয়ে হাজির ইজ়রায়েলের সেনারা । শত্রু সংহারে এ বার লেজ়ার বিম ব্যবহার করবে তারা। শুধু তাই নয়, যৎসামান্য খরচে যাবতীয় ‘হাওয়াই হামলা’ এই অস্ত্রটি আটকে দেবে বলেও দাবি করেছে তেল আভিভ।
পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে ‘গেম চেঞ্জার’ হতে চলেছে আয়রন বিম’ । ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) সূত্রে খবর, আয়রন বিমের যাবতীয় পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। আগামী বছরের গোড়াতেই একে বিভিন্ন মোর্চায় মোতায়েন করবে ইহুদি সেনারা।
এখন প্রশ্ন হল, কী এই আয়রন বিম? এটি প্রকৃতপক্ষে একটি ‘বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) যার সাহায্য শত্রুদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট মাঝ আকাশেই ধ্বংস করতে পারবে আইডিএফ। তবে কোনও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নয়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজ়ার বিম ব্যবহার করে এই ধরনের আক্রমণ আটকাবে আয়রন বিম।
ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, আয়রন বিম রকেট এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও মর্টারের গোলা এবং ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম। ২০২১ সালে এই হাতিয়ারের একটি নমুনা তৈরি করা হয়েছিল। তখন থেকেই আইডিএফের অস্ত্রাগারে আয়রন বিমকে যুক্ত করতে মরিয়া ছিলেন ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা।
সংবাদ সংস্থা ‘সিএনএন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইজ়রায়েলের এই নতুন হাতিয়ারটি থেকে ১০০ কিলোওয়াটের লেজ়ার বিম ছোড়া যায়। যার পাল্লা সাত কিলোমিটার। অর্থাৎ এই দূরত্বে কোনও রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বা মর্টার চিহ্নিত হলে, তা আকাশেই ধ্বংস করতে পারবে আয়রন বিম।
দ্বিতীয়ত, আয়রন বিমকে একরকম অদৃশ্য হাতিয়ার বলা যেতে পারে। কারণ, লেজ়ার বিম খালি চোখে দেখা যায় না। ফলে শত্রুর পক্ষে তাঁদের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে কোন রাস্তা দিয়ে লেজ়ার বিম ছুটে আসবে তা বোঝা শক্ত।
বর্তমানে স্বল্পপাল্লার রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র মাঝ আকাশে ধ্বংস করার জন্য ইহুদি সেনার হাতে রয়েছে ‘আয়রন ডোম’ নামের একটি বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। গত এক বছরে যার উপর নির্ভর করে হামাস-হিজ়বুল্লা-হুথি এবং ইরানের বহু আক্রমণ ঠেকিয়েছে আইডিএফ। কিন্তু সম্প্রতি এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী বছর থেকে আয়রন ডোমের জায়গায় আয়রন বিম ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর এই নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আইডিএফ। ইহুদি সেনারা জানিয়েছে, নতুন বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হাতে পেতে ৫.৩৬ কোটি ডলার খরচ করবে তেল আভিভ।
ওই অর্থে আয়রন বিম তৈরির জন্য ‘রাফাল অ্যাডভান্স ডিফেন্স সিস্টেমস’ এবং ‘এলবিট সিস্টেমস’-এর সঙ্গে চুক্তি সেরে নিয়েছে ইজ়রায়ালি প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। হাতিয়ার নির্মাণকারী এই দু’টি সংস্থাই ইহুদি দেশটির নিজস্ব। তবে মোট কত ইউনিট আয়রন বিমের বরাত দেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, বিপুল খরচ আটকাতেই আয়রন ডোমের বদলে আয়রন বিমকে রণাঙ্গনে আনতে চাইছে ইজ়রায়েল। আয়রন ডোমে যে রকেট রয়েছে, তার নাম ‘তামির’। যার এক একটির দাম ৫০ হাজার ডলার। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪২ লক্ষ টাকা।
অন্য দিকে হামাস বা হিজ়বুল্লার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলি ইহুদি ভূমিতে যে রকেট ছোড়ে সেগুলির দাম মাত্র ৩০০ ডলার। গত এক বছর ধরে যখনই তাঁরা হামলা চালিয়েছে, তখন একসঙ্গে ১৫০-২০০ বা আরও বেশি রকেট দেগেছে ইরানের মদতপুষ্ট এই দুই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। আয়রন ডোমের সাহায্যে যা ঠেকাতে জলের মতো খরচ হয়েছে আইডিএফের।
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, আয়রন বিম চলে এলে এই সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে। কারণ, এর থেকে একটি লেজ়ার বিম ছুড়তে খরচ হবে মাত্র দুই ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১৭০ টাকা। সে ক্ষেত্রে হামাস বা হিজ়বুল্লার রকেট হামলার খরচ অনেক বেশি পড়বে।
ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল ইয়াল জমির বলেছেন, ‘‘আয়রন বিম যুদ্ধে একটা নতুন যুগের সূচনা করবে।’’ এই ধরনের লেজ়ার হাতিয়ারের ব্যবহার বিশ্ব আগে দেখেনি বলেও দাবি করেছেন তিনি।
তবে আয়রন বিমের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেঘলা আবহাওয়া বা বৃষ্টিতে এটি ঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না। তা ছাড়া এটি চালাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। সেখানে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি থাকলে এটিকে আর ব্যবহার করা যাবে না।
গত ২৫ অক্টোবর ইরানের রাজধানী তেহরান-সহ একাধিক জায়গায় আক্রমণ শানায় ইহুদি বায়ুসেনা। সূত্রের খবর, সেই হামলায় শিয়া দেশটির হাতে থাকা রাশিয়ার তৈরি ‘এস-৩০০’ বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। যার জেরে প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনাই।
এ বছরের ১ অক্টোবর ইহুদি ভূমিতে প্রায় ২০০টি ‘হাইপারসনিক’ ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায় ইরানি সেনাবাহিনী তথা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডস কোর’ (আইআরজিসি)। তেহরানে হামলার প্রতিশোধ নিতে ফের একবার সেই রাস্তাতেই শিয়া সেনারা হাঁটতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
আইআরজিসির ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে আমেরিকার থেকে ‘থার্মাল হাই অল্টিচুড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড নামের একটি বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে আইডিএফ। দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে মাঝ আকাশে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে যা সিদ্ধহস্ত। এটি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় বাহিনীও
এই থাড ছাড়া আইডিএফের হাতে আরও দু’টি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। তা হল, ‘ডেভিডস্ স্লিং’ এবং ‘অ্যারো’। মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং রকেট এর সাহায্যে আটকাতে সক্ষম ইহুদি সেনা। ফলে আইআরজিসির পক্ষে প্রত্যাঘাত শানানো যে খুব একটা সহজ নয়, তা বলাই বাহুল্য।