রাসুল (সা.)-এর ন্যায়বিচার যেমন ছিল


ধর্ম ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 15-10-2024

রাসুল (সা.)-এর ন্যায়বিচার যেমন ছিল

ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিয়ে দুনিয়ায় আসেন মহানবী (সা.)। তিনি ছিলেন নবী। জীবনের পরতে পরতে ইসলামের প্রতিটি বিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন।

মহানবী (সা.) কোরআনের সেই নির্দেশ ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়বিচার করবে’ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। মহানবী (সা.) আল্লাহর এই বিধানের আলোকে ইনসাফের রাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বিচারের ক্ষেত্রে কোনোরূপ শীতলতা প্রদর্শন করেননি। তাঁর ন্যায়বিচারের এমন অনেক নজির রয়েছে ইতিহাসে।

একবার মাখজুম গোত্রের এক নারীর চুরির ঘটনায় তাকে দণ্ডাদেশ দেওয়া হলো। ওই নারীর দণ্ডাদেশ মওকুফ করার জন্য নবীজি (সা.)-এর প্রিয় ব্যক্তি উসামা (রা.) সুপারিশ করেন। সুপারিশ শুনে মহানবী (সা.) উসামা (রা.)-এর ওপর খুব নাখোশ হন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যদি আমার মেয়ে ফাতিমাও চুরি করত, অবশ্যই আমি তার হাত কেটে দিতাম।

’ (বুখারি, হাদিস : ৪৩০৪)

এভাবেই মহানবী (সা.) বিচারপ্রার্থীকে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে মোটেও কার্পণ্য করেননি। মহানবী (সা.) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তখন আরবে মূর্তিপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। নবুয়ত লাভের পর মহানবী (সা.) মূর্তির বিপক্ষে অনেক কথা বলেছেন। এই ভয়াবহ শিরক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লোকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে তিনি এসব মূর্তি ভেঙে ফেলার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। অথচ এ সময় মুসলমানরা মোটামুটি শক্তিশালী অবস্থানেই ছিল। তার পরও মহানবী (সা.) আইনকে নিজের হাতে তুলে নেননি, বরং তিনি যখন মক্কা বিজয় করলেন এবং ইসলামের পতাকা মক্কার আকাশে উড্ডীন করলেন, ঠিক তখনই কাবাঘরে রক্ষিত মূর্তিগুলো অপসারণ করেন এবং ভেঙে ফেলেন।

এভাবে মহানবী (সা.) আইন প্রয়োগের ক্ষমতা লাভ করেই ক্ষমতার বাস্তবায়ন করেন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম হলো জবাবদিহি নিশ্চিত করা। মহানবী (সা.) প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আল্লাহর বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে জবাবদিহির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে, ‘আমানত বহনের যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে আমানত সোপর্দ করার জন্য আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর বিচারব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, সর্বগ্রাহ্য, উন্মুক্ত এবং যুক্তিসংগত প্রমাণাদি ও ইনসাফের মানদণ্ডে সমৃদ্ধ। তাঁর বিচারের ভিত্তি ছিল আল-কোরআনের নির্দেশনার অনুকরণ। বিচারের বেলায় পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, প্রতিহিংসা চরিতার্থ, হীন স্বার্থ সংরক্ষণ ইত্যাদির কোনো প্রতিফলন ছিল না। মহানবী (সা.) কোরআনের নির্দেশনার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ইনসাফের ধারক হও এবং আল্লাহর ওয়াস্তে সাক্ষী হও তোমাদের এ সুবিচার ও সাক্ষ্যের আঘাত তোমাদের নিজেদের ওপর কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়দের ওপরই পড়ুক না কেন, আর পক্ষদ্বয় ধনী কিংবা গরিব যা-ই হোক না কেন, তাদের সবার চেয়ে আল্লাহর এ অধিকার অনেক বেশি যে তোমরা তাঁর দিকেই বেশি লক্ষ রাখবে। অতএব, নিজেদের নফসের খায়েশের অনুসরণ করতে গিয়ে সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতা থেকে বিরত থেকো না। তোমরা যদি কারোর মন রেখে কথা বলো কিংবা সত্যবাদিতা থেকে দূরে থাকো তবে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।’ (সুরা : আন-নিসা, আয়াত : ১৩৫)

মহানবী (সা.) ধনী-গরিব-আত্মীয়-অনাত্মীয়-প্রভাবশালী-অপ্রভাবশালী-নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। একদিন একজন মুসলিম ও প্রতিপক্ষ একজন অমুসলিম এক নালিশ নিয়ে মহানবী (সা.)-এর দরবারে গেল। উভয়ের জবনবন্দি ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মুসলিম লোকটিকে দোষী বলে প্রমাণিত হলো। তাই রায় গেল অমুসলিম লোকটির পক্ষে। এ ব্যাপারে মুসলিম লোকটি অখুশি হয়ে মামলাটি আবার উমর (রা.)-এর কাছে পেশ করল। উমর (রা.) নালিশ ও বিচারের আদ্যোপান্ত অবহিত হলেন এবং মুসলমান ব্যক্তিটিকে হত্যা করেন। এ ঘটনার পর থেকে উমর (রা.) ‘ফারুক’ নামে অভিহিত হন। ‘ফারুক’ অর্থ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী।

মহানবী (সা.) নিজেই কেবল সুবিচার নিশ্চিত করেছিলেন, তা নয়; তাঁর সাহাবিরাও সুবিচারের আদর্শে ছিলেন বলীয়ান। মহানবী (সা.)-এর দেখানো পথ থেকে তাঁরা বিন্দু পরিমাণ ব্যত্যয় করেননি। আলী (রা.) তখন মদিনা রাষ্ট্রের খলিফা। একবার তাঁর প্রিয় বর্মটি হারিয়ে গেল। বর্মটি একজন ইহুদির কাছে ছিল। সে বর্মটি বাজারে বিক্রি করতে গেলে আলী (রা.) সেটি চিনে ফেললেন। ইহুদিকে তিনি বলেন, ‘বর্মটি আমার। এটি আমার উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছিল। এটি আমাকে ফেরত দাও।’ ইহুদি বলল, ‘না জনাব! বর্মটি আমার আর এটি আমার অধিকারেই আছে। আপনি এটি দাবি করতে পারেন না।’ এরপর লোকটি বর্মের অধিকার নিয়ে মীমাংসার জন্য কাজির দরবারে গেল। আলী (রা.) খলিফা হয়েও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে একদিন কাজির দরবারে গিয়ে হাজির হলেন। কাজি ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবি শুরাইহা (রা.)।

কাজি জানতে চাইলে আলী (রা.) বলেন, ‘এই লোকটার হাতে যে তরবারি আছে এটি আমার। আমি এটি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার অনুরোধ, আপনি লোকটিকে বর্মটি ফেরত দিতে আদেশ দেবেন।’ এরপর কাজি ইহুদির বক্তব্য জানতে চাইলে লোকটি বলল, ‘জনাব! এটি আমার বর্ম। বর্তমানে এটি আমার দখলেই আছে। আমি আমিরুল মুমিনিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি না যে তিনি মিথ্যা অভিযোগ করছেন।’

এরপর মহামতি কাজি বললেন, ‘মহামতি খলিফা! আমার সন্দেহ নেই যে আপনার কথাই সত্য। আর এটাও আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে বর্মটি আপনার নয়। তবে যেহেতু বিচারের ব্যাপার, তাই আপনার দাবির পক্ষে দুজন সাক্ষীর প্রয়োজন।’

আলী (রা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমার দাবির পক্ষে দুজন সাক্ষী আছে। এরা হলেন আমার ছেলে হাসান এবং আমার ক্রীতদাস কাম্বার।’ কাজি শুরাইহা (রা.) বললেন, ‘আমি দুঃখিত খলিফা মহোদয়। পিতার পক্ষে সন্তানের সাক্ষ্য ইসলামের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমি হাসানের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারছি না।’

কাজির বক্তব্য শুনে আলী (রা.) অবাক হয়ে বলেন, ‘কী আশ্চর্য বিষয় কাজি সাহেব! আপনি জানেন হাসান আল্লাহর নবী (সা.) ঘোষিত জান্নাতি যুবকদের সরদার। তাঁর সাক্ষ্যও গৃহীত হবে না?’ আলী (রা.) এবার নিরূপায় হয়ে ইহুদি লোকটির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ঠিক আছে, তুমি বর্মটি নিয়ে যাও। কারণ আমার দাবির পক্ষে তো কোনো সাক্ষী নেই। আমি আমার দাবি প্রত্যাহার করে নিলাম।’

আলী (রা.)-এর কথা শুনে ইহুদির বুক কেঁপে উঠল। কেননা সে জানে এই বর্মটি তার নয়। এক্ষণে ইহুদি আলী (রা.)-এর মহত্ত্ব ও কাজির ন্যায়বিচার দেখে ক্ষমা চাইল। আর নিজে ইসলামে দীক্ষিত হলো। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়াহ ৯/২৫)

এটাই ছিল ইসলামে ন্যায়বিচারের নমুনা। এই আদর্শই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন মহানবী (সা.)। আজও ইতিহাসের পাতায় ন্যায়বিচারের এ রকম অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। যত দিন মুসলমানরা ন্যায়নীতির এই আদর্শকে ধারণ করে চলবে, তত দিন বিজয় হবে ইসলামের। ইসলামের পরম শক্রও ইহুদি ব্যক্তিটির মতো ইসলামের ছায়াতলে এসে সমবেত হবে।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]