ছোট ছোট মেঘ দলের সমাবেশ। হঠাৎ বিকট শব্দে বিদ্যুতের আগমন সাথে ভারি বর্ষণ। ব্যাপ্তি (সন্তান) বিচ্ছেদে মায়ের আর্তনাদে লোনাপানির সংযুক্তি। প্লাবনের জোয়ারে তীব্রতা। ঘনঘন আঘাতে ভেঙে চুরমার জালিমের মসনদ। অতঃপর নবভোরে ঊষার স্নিগ্ধ আলোতে চমকিত ধমনী। খুশির লগ্ন এল ফের একরাশ আশা বুকে বেঁধে সম্মিলিত সুরে শোনা গেল এই তো আমরা সফল।
ঠিক এভাবেই যেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল চিত্রগুলো বিশ্ববাসীকে জানান দিচ্ছে, 'ওহে বিশ্ববাসী জেনে নাও, আমরা সহ্য করেছি, সুযোগ দিয়েছি, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে অতঃপর সংগঠিত হয়ে জালিমের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছি, আমরা মরেছি এবং নতুন ভোর ছিনিয়ে এনেছি।'
এ কথারই সত্যতা নিশ্চিতে প্রথমেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিতে আকুতি জানায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যাকাডেমিক ভবনের দক্ষিণ দেয়ালের একটি চিত্র। যেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপ্রেরণায় (লাইটযুক্ত চোখ) ২০২৪ সালে লাশের মিছিলের মাধ্যমে স্বাধীনতা ২.০ অর্জনকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চিত্রটির ঠিক মাঝখানে। তাতে লেখা হয়েছে, 'অতঃপর আবারও লাশ', 'লাশ আবার লাশ, আরেকটা লাশ, আরও একটা লাশ, তারপর লাশ'!
ঠিক এ চিত্রের ডানে ও বামে দু'টি করে চারটি চিত্রে ২৪'র স্বৈরাচারীর দোসরদের কারনামাকে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
ডানের প্রথম চিত্রে, আন্দোলনরত এক নারী শিক্ষার্থীর ওড়না ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। দ্বিতীয় চিত্রে অপর এক শিক্ষার্থীকে দু'জন পুলিশ জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে।
অন্যদিকে বামের প্রথম চিত্রে, আন্দোলনে নিহত এক বোনকে নিয়ে ছুটে চলেছেন কিছু শিক্ষার্থী। চোখে-মুখে শঙ্কা আর ভীতি। নিচের চিত্রে ছাত্রলীগের 'সন্ত্রাসী বাহিনী' দ্বারা আক্রমণের শিকার ছাত্রীদের পিটুনির চিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
অপর একটি দেয়ালিকাতে শিক্ষার্থীরা এঁকেছেন বাংলার জনতা সাহসী হয়ে উঠে দাঁড়ানোর এক দারুণ শিল্পকর্ম। যাতে প্রতিবাদী এক যুবক তর্জনী উঁচু করে বলছে 'আওয়াজ উডা কথা ক' এ যেন প্রতিবাদী হয়ে সকল অনিয়ম রুখে দিতে, সব জুলুমের শৃঙ্খল ভেঙে চুরমার করতে অসীম সাহস জাগানিয়া এক অনন্য নিদর্শন।
এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, রয়েছে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে সর্বসাধারণের ভূমিকা তুলে ধরা ছোট্ট এক চিত্রকর্ম। যেখানে দাবার চালে স্বৈরতন্ত্রের রাজসভার প্রধানকে ক্ষমতার মসনদ থেকে কিক মেরে সরিয়ে দিচ্ছে জনগণ। যা রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের দক্ষিণ দেয়ালে চিত্রায়িত করা হয়েছে শেখ হাসিনার এক ব্যঙ্গচিত্র। যাতে শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে, শেখ হাসিনা জনতাকে দেখিয়ে কান্না করছে একই সাথে ভিক্টোরি চিহ্ন 'V' রয়েছে তার হাতে। অর্থাৎ জনতার সামনে অভিনয় করলেও আসলে তিনিই এসব হত্যাকাণ্ডের সরাসরি নির্দেশদাতা ছিলেন সেটিই বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি তার এসব কর্মকাণ্ডকে জনতা নাটক হিসাবে ধরে নিয়েছে তা বোঝাতে উপরের ডান পাশে লিখা হয়েছে 'নাটক কম করো পিও'।
পুরো ক্যাম্পাসেই এমন নানান চিত্রকর্মের মধ্যে নজর কাড়ার মতো আরেকটি চিত্র হলো 'বিজয় উল্লাস'। এটি প্রথম বিজ্ঞান ভবনের পূর্ব দেয়ালে অঙ্কিত একটি ঐতিহাসিক চিত্র। যেখানে ফুটে উঠেছে নবঊষার আগমনে লালসবুজ পতাকা হাতে আসমানে বিজয় নিশান উড়াচ্ছে দু'জন ছাত্র। দু'পাশে হিন্দুর অক্ষরে লিখা 'আমি ছাত্র আমি অদম্য, আমি এক বিদ্রোহী আত্মা'।
গ্রাফিতি করব টিমের ফাউন্ডার মেম্বার ও চারুকলা অনুষদের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিয়া মৌমি বলেন, আমদের গ্রাফিতি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রজনতার প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের কি কি অতিক্রম করতে হয়েছে এবং বর্তমান বাংলাদেশে কি কি সংস্কার প্রয়োজন, তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এখানে মূলত আমরা আমাদের সম্প্রতি ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছি। যেমন, স্বৈরাচার সরকারের শাসনামলে নির্বিচারে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে কিভাবে স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়েছে এবং সেখানে ছাত্র-জনতার পাশে কারা লড়াই করে এই বিজয় আনতে সাহায্য করেছেন। এছাড়াও বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে এমন কিছু সমস্যাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
গ্রাফিতি যেহেতু স্বাধীনতা চর্চার একটি অংশ তাই আমরা সামনের দিনগুলোতে এটিকে চলমান রাখার চেষ্টা করবো। একইসাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাবর্ধনে কাজ করবো। এছাড়াও ভবিষ্যতে আমাদের একটি মূল উদ্দেশ্য থাকবে, ক্যাম্পাসের সকল প্রতিভাবান শিক্ষার্থী যেন তাদের ছবি আঁকার প্রতিভাকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়।