মুখোশের আড়ালে ভয়ানক প্রতারণার মাধ্যমে ১৯ মাসের বকেয়া ভাড়া না দেওয়ায় নিউ ইয়র্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের স্বত্তাধিকারী আবু জাফর মাহমুদকে অফিস থেকে উচ্ছেদ করেছে নিউ ইয়র্কের কুইন্স কাউন্টি সিভিল আদালত। ২ লাখ ৩১ হাজার ৫ শত ৭ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার ৮ শত ৪০ টাকা) দিতে অপারগ বলে আদালতে কান্নাকাটি করে ক্ষমাও চেয়েছেন আবু জাফর মাহমুদ। এ বিষয়টি নিশিচত করেছেন জামাইকার নিহারিকা এনওয়াইসি কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের আইনজীবী জন সিয়াফোন।
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম জানান, ১৯ মাসের বকেয়া ভাড়া ২ লাখ ৩১ হাজার ৫ শত ৭ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার ৮ শত ৪০ টাকা) না দিয়ে আমাকে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করেছে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ানক প্রতারক আবু জাফর মাহমুদ। গত ১ অক্টোবর ২০২৪ তাকে অফিস ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন নিউ ইয়র্কের কুইন্স কাউন্টি সিভিল আদালত। আদালত উক্ত নির্দেশকেও অমান্য করে পরদিন ২ অক্টোবর অফিস ছেড়ে দেন তিনি।
তিনি বলেন, ১৯ মাসের বকেয়া ভাড়া দেওয়ার মতো তার এখন সাধ্য নেই বলে আদালতে কান্নাকাটি করে ক্ষমাও চেয়েছেন। অথচ আমার অফিস ছাড়ার আগেই একই এলাকায় (জামাইকার ১৫৩-৩৮ হিলসাইড এভেন্যুতে অন্য একটি অফিস ভাড়া নিয়ে স্থান পরিবর্তনের নোটিশ টাঙিয়ে দেন একই অফিসের দরজায়।
আবু জাফর মাহমুদের বিরুদ্ধে প্রচুর ট্যাক্স ফাঁফির অভিযোগ রয়েছে। যে কোন সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে গ্রেপ্তার হতে পারেন বলেও উল্লেখ করেন জামাইকার নিহারিকা এনওয়াইসি কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী আমিনুল ইসলাম।
মামলার বিবরণে জানা যায়, জামাইকার হিলসাইড এভেনিউতে (১৪৭-১৪) তার একটি ভবন ভাড়া দেওয়া হবে এমন খবর পেয়ে নিউ ইয়র্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের স্বত্তাধিকারী আবু জাফর মাহমুদ সেটি ভাড়া নেবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অফিস ভাড়া সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে উভয়ের মধ্যে নানা আলোচনা হয় এবং শেষে তারা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। রিয়েল ইষ্টেট ব্রোকার ও উভয় পক্ষের অ্যাটর্নি উপস্থিতিতে গত ২১ মার্চ ২০২৩ তারা চুক্তির কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন। নিউ ইয়র্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের সাথে জামাইকার নিহারিকা এনওয়াইসি কর্পোরেশন হিলসাইড এভেনিউয়ের উক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের ভাড়ার জন্য উভয় পক্ষ চুক্তিবদ্ধ হন।
ভাড়া সংক্রান্ত প্রাথমিক আলোচনাকালে জাফর মাহমুদ অফিসটি ২০ বছরের জন্য ভাড়া নেবার আগ্রহ দেখান। সেই মোতাবেক তাকে চুক্তিনামা তৈরি করতেও বলেন। মেয়াদ শেষে আবারও ১০ বছর নবায়ন করতে পারবেন বলে জানালে জাফর মাহমুদ তাতে রাজি হন। পরে ১০ বছরের জন্য তারা চুক্তিবদ্ধ হন। মৌখিক আলোচনায় ২ মাসের ভাড়া (বাংলাদেশি ভাড়াটে বিবেচনা করে) পরিপূরক বা কমপ্লিমেন্টারি হিসেবে ধরা হয়। প্রথম ৬ মাসের মোট বকেয়া ভাড়ার পরিমান দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ১ শত ৭৯ ডলার। সেই সাথে ২ মাসের পরিপূরক বা কমপ্লিমেন্টারি ২১ হাজার ৯ শত ৫৯ ডলার ভাড়া যোগ করা হলে মোট ভাড়ার পরিমান দাঁড়ায় ৮৬ হাজার ১ শত ৩৮ ডলার। উক্ত বকেয়া ভাড়া পরিশোধের জন্য আমিনুল বেশ কয়েকবার তাগিদ দেন জাফর মাহমুদকে, কিন্তু তিনি তা পরিশোধ করেননি।
বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ভাড়া নিয়ে অফিস চালুর আগেই উপর তলায় আবাসিক হিসেবে সপরিবারে বসবাস শুরু করেছেন বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের কর্মকর্তা-কর্মচারি। গত বছর ৬ মাস কোন ভাড়া না দিয়ে উল্টো ভবন মালিককে ইজারা লঙ্ঘনের অভিযোগে আইনি নোটিস পাঠিয়ে হয়রানি করেন আবু জাফর মাহমুদ। ঐ সময়ে ভাড়া প্রদানে অক্ষমতা ও মোটা অংকের বকেয়া আদায়ে বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের মালিক আবু জাফর মাহমুদের নামে সমন জারি করেন আদালত।
এদিকে চুক্তি সম্পাদনের এক সপ্তাহের মধ্যেই তার অফিসের একজন কর্মচারি পরিবারসহ উপর তলায় ভাড়াটে হিসেবে উঠে পড়েন। অফিসের একজন কর্মচরি উপরে থাকবেন বলে আমিনুলকে বলা হয়েছিল। কিন্তু বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানে বসবাস করবেন এমন কোন কথা আগে বলা হয়নি। এরই মধ্যে অফিসে সদর দরজা ও উপরে বাসায় যাবার দরজায় তালা পরিবর্তন করে নতুন তালা লাগানো হয়। ফলে অফিসের ভিতরে তারা কি ধরণের সংস্কারে কাজ করছেন আমিনুলের পক্ষে তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এমনকি সিটি বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের অনুমতি ছাড়াই নতুন বাথরুমসহ বৈদ্যুতিক কাজ কর্ম সম্পাদন করায় তা দেখে আমিনুল হতাশ হয়ে পড়েন। বকেয়া ভাড়া না দিয়েই তালা পরিবর্তনের ঘটনায় ভিতরের টুকিটাকি কাজে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। নতুন চাবিও বিল্ডিং এর মালিককে দেওয়া হয়নি। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন আমিনুল। এরই মধ্যে গত বছর ১১ জুলাই আমিনুল ফেডেক্সের মাধ্যমে একটি আইনি নোটিস হাতে পান। তাতে আমিনুলের বিরুদ্ধে ইজারা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। নোটিসে বলা হয় আমিনুল দোকানসহ দুটি এপার্টমেন্টের কথা বলেছিলো কিন্তু বাস্তবে একটি এপার্টমেন্ট পাওয়া গেছে। সেখানে কোন গ্যাসের সংযোগ, তাপ সংযোগ এবং গরম পানির কোন ব্যবস্থা নেই।
আবু জাফর মাহমু্দের অ্যাটর্নির পাঠানো উক্ত চিঠির ব্যাখা দিয়ে আমিনুল বলেন, গরম পানি না থাকলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তার কর্মচারি গত মার্চ মাস থেকে কীভাবে সেখানে বসবাস করছেন। চুক্তিপত্রে কোন এপার্টমেন্টের কথাই উল্লেখ নেই। এটা আবাসিক ভবন নয়, সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তবে যেহেতু ভাড়াটে একজন বাংলাদেশি সেটা বিবেচনা করে এবং যেহেতু উপরে থাকার পরিবেশ রয়েছে তাই যে কোন ব্যক্তি সেখানে বসবাস করতে পারবেন, কিন্তু কোন সাবলেট হিসেবে নয়। যুক্তরাষ্ট্রে নবাগত এবং ভাড়াটের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আদিত্য শাহীন নামে্র একজন সংবাদকর্মী জাফর মাহমুদকে প্রতিমাসে আড়াই হাজার ডলার করে পরিশোধ করেন বলে আমিনুলের কাছে তিনি স্বীকার করেন শাহীন।
ভবন মালিক আমিনুল বলেন, চুক্তিপত্র সম্পাদনের আগে বেশ কয়েক দফা তা পরিবর্তন করা হয়।আবু জাফর মাহমুদ বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন যে কোন সময় উক্ত প্রোপার্টি বিক্রি করা হলে তাকেই যেন প্রথম ক্রেতা হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আ্মিনুল তাতে রাজি হয়নি। তিনি বলেন যখন বিক্রি করবো তখন দেখা যাবে। এতে কিছুটা মনক্ষুণ্ন হয়ে পড়েন জাফর।
চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী জামানতের ৩ মাসের অগ্রিম অর্থ পেতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে আমিনুলকে। ৩ মাসের অগ্রিম জামানত বাবদ ৩১ হাজার ৫শত ডলার ক্যাশিয়ার বা ব্যাংক চেকের মাধ্যমে পরিশোধের দাবি জানান আমিনুল। এতে আপত্তি জানান জাফর। তিনি ব্যক্তিগত চেকের মাধ্যমে তা পরিশোধ করতে চান। এভাবেই কেটে যায় প্রায় দু’সপ্তাহ। ব্যক্তিগত চেক ক্যাশ না হওয়া পর্যন্ত চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হবে না এই শর্তে উভয়েই রাজি হলে পরে বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
উল্লেখিত শর্ত মোতাবেক ভাড়াটে তার নিজের নামে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তাপ ও পানি সবকিছু এক মাসের মধ্যেই ভাড়াটিয়ার নামে একাউন্ট খুলে তা চালু রাখার কথা। জাফর মাহমুদ গত বছর ৬ মাসেও তা করেননি। ফলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নিয়মিত আমিনুলের নামে বিল পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন কোন গ্যাসের সংযোগ ছিল না উক্ত ভবনে। তাই নতুন করে বিল্ডিং পরিদর্শনের পর গত ১২ জুলাই গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। তালা পরিবর্তনের ফলে প্লাম্বিং কোম্পানি বৈদ্যুতিক সংযোগের সাথে গ্যাসের সংযোগ দিতে ব্যর্থ হয়ে ফেরত যান। দীর্ঘ ৬ মাসেও ভাড়াটিয়ার নিজের বৈদ্যুতিক একাউন্ট না করায় দেড় মাস অপেক্ষার করে নিরুপায় হয়ে বিল্ডিং এর মালিক আমিনুল নিজের নামে গ্যাসের একাউন্ট খুলে বৈদ্যুতিক সংযোগের সাথে গ্যাস সংযোগ করে দেন। ভাড়া না পেয়েও বিল্ডিং মালিককে আবারও মোটা অংকের অর্থ খরচ করতে হয়েছে উক্ত কাজগুলো সম্পাদন করতে। শেষে আদালতের শরণাপন্ন হন আমিনুল। বিজ্ঞ আদালত ভাড়া প্রদানে অক্ষমতা ও মোটা অংকের বকেয়া আদায়ে বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের স্বত্তাধিকারী আবু জাফর মাহমুদের নামে গত ১১ সেপ্টেম্বর’ ২৩ একটি সমন জারি করেন।
আমিনুল বলেন, পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যা খুবই কম। নিউ ইয়র্কের অধিকাংশ মানুষই আবু জাফর মাহমুদকে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবেই চেনেন এবং জানেন। কিন্তু তার ভেতর ও বাইরের চরিত্র একেবারেই ভিন্ন। নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সভামঞ্চে তিনি দেশাত্ববোধ ও সমাজ সেবক সেজে নানা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। মানুষকে অশান্তিতে রেখে সমাজ সেবা আর শান্তির বুলি ছড়িয়ে কী লাভ। আজ হোক আর কাল হোক মানুষ ঠিকই তার আসল চরিত্র খুঁজে বের করবে। সরাসরি তার সাথে না মিশলে বা ব্যবসায়িক লেনদেন না করলে শুধু আমি না কেউই জানতে পারবেন না মুখোশের আড়ালে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা। তার আসল পরিচয় খুব শিগগির সমাজের মানুষের কাছে বেরিয়ে আসবে বলে আশা করেন তিনি। তবে 'মুখোশের আড়ালে ভয়ানক ভন্ডামি' নিউ ইয়র্কে ৬ মাসের বকেয়া অফিস ভাড়া আদায়ে জাফর মাহমুদের নামে আদালতের সমন শিরোনামে প্রথম সংবাদ প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলা সংবাদমাধ্যম বাংলা প্রেস বলে উল্লেখ করেন আমিনুল।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের সাথে জাফর মাহমুদের এ রকম আচরণ করাটা মোটেই ঠিক হয়নি। এটা একটা ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই না। ভন্ডামিরও একটা সীমা থাকে। ভদ্রলোকের মুখোশ পরে মুখে এক রকম কথাবার্তা আর অন্তরে নোংরামি এ ধরনের মানুষের কাছ থেকে প্রবাসীদের দূরে থাকার পরামর্শ দেন আমিনুল। তিনি বলেন, তার খপ্পরে পড়ে আমার মত আর কোন প্রবাসীর যেন সর্বনাশ না ঘটে। সেজন্য প্রবাসীদের সজাগ থাকারও পরামর্শ দেন তিনি।
আদালত থেকে উচ্ছেদের পর প্রতিক্রিয়া জানতে বাংলা সিডিপ্যাপ ও আলেগ্রা হোম কেয়ারের স্বত্তাধিকারী আবু জাফর মাহমুদকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।