চাকরির লোভে ভারতে গিয়েছিলেন ৩ বাংলাদেশি নাগরিক। দেশটিতে পৌঁছানোর পর তারা ৩ জনই কিডনি পাচারকারী সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েন এবং এরপর তারা প্রত্যেকেই তাদের একটি করে কিডনি হারিয়েছেন।
ভারতের আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের দাখিল করা সাম্প্রতিক অভিযোগপত্রে বাংলাদেশের ওই তিন নাগরিক তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ভারতে পরিচালিত বিস্তৃত কিডনি পাচার চক্রের কথা ফাঁস করেছেন। সেখানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) পৃথক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং ইকোনমিক টাইমস।
কিডনি পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা কাজের লোভ দেখিয়ে মেডিকেল ভিসায় বাংলাদেশিদের ভারতে নিয়ে গিয়ে তাদের কিডনি কেড়ে নিত। বিনিময়ে তাদের সামান্য কিছু অর্থও দেওয়া হতো। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে ওই কিডনি চক্রের শিকার হওয়া তিন বাংলাদেশির কথাই জানানো হয়েছে।
ভারতীয় এই সংবাদমাধ্যম অবশ্য ভুক্তভোগী ওই তিন ব্যক্তিরই পরিচয় গোপন রেখেছে। তাদের মধ্যে প্রথম জনের নামের দুটি অক্ষর টিআই এবং তার বয়স ৩০ বছর। বাংলাদেশে তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন। কিন্তু দোকানে আগুন লেগে তার পুরো ব্যবসা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এক এনজিও থেকে তিনি ৮ লাখ টাকা ধার নিয়ে ফের নিজের ব্যবসা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ৩ লাখ টাকার বেশি ঋণ শোধ করতে পারেননি।
একপর্যায়ে আর্থিক চাপের মুখে এক বন্ধুর পরামর্শ নিতে যান তিনি। আর সেই বন্ধুই তাকে দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরুর পরামর্শ দিয়েছিল। এছাড়া সেই বন্ধুই তাকে পাসপোর্ট, মেডিকেল ভিসা এমনকি ভারতে চাকরিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
তবে, গত ১ জুন ভারতে যাওয়ার পর ওই ব্যক্তি জানতে পারেন, সেখানে তার জন্য চাকরি-বাকরি কিছুই নেই। এর বদলে তাকে কিডনি বিক্রি করতে হবে। প্রথমে তিনি রাজি হননি। কিন্তু তার পাসপোর্ট এবং ভিসা কেড়ে নিয়ে ওই চক্রের তারা বলেছিল, কিডনি না বিক্রি করলে তিনি আর কোনোদিন ভারত থেকে ফিরতে পারবেন না। ফলে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কিডনি বিক্রি করতে।
ভুক্তভোগী বাংলাদেশি দ্বিতীয় ব্যক্তির বয়স ৩৫ বছর এবং তার নামের দুটি অক্ষর এসএস। তাকেও ভারতে চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। তাসকিন নামে এক ব্যক্তি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিল দিল্লিতে। গত ২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে পৌঁছানোর পর দুজন লোক তাকে যশোলার হোটেল রামপালে নিয়ে যায়। ওই দুই ব্যক্তির নাম রাসেল ও মোহাম্মদ রোকন।
এরপর তারা তাকে বলেন, সেখানকার এক হাসপাতালে চাকরি পাবেন তিনি। আর সেটির জন্য তার বেশ কিছু মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার। রক্ত পরীক্ষা ও ইসিজি-সহ প্রায় ১৫-২০টি পরীক্ষা করা হয় তার। তারপর এপ্রিলের ২ তারিখে তাকে আবারও হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং এক নার্স তাকে একটি ইনজেকশন দিতেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
এরপর ৩ এপ্রিল তার জ্ঞান ফিরলে তাকে আবারও ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং তিনি আবারও অজ্ঞান হয়ে যান। এর দুদিন পর এপ্রিলের ৫ তারিখ তার জ্ঞান ফেরে। কিন্তু তিনি দেখেন তার পেটে একটি সেলাইয়ের দাগ রয়েছে। পরে তাকে জানানো হয় তার একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। এরপর ৬ এপ্রিল রাসেল ও তার সহযোগী সুমন তাকে যশোলার ওই হোটেলে নিয়ে যান।
পরে রাসেল তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিশদ তথ্য জেনে নেন এবং সেখানে ৪ লাখ টাকা জমা করা হয়। তবে তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপরই তাকে জানানো হয়, তিনি চাকরি পাবেন না। আর তাই তাকে বাংলাদেশে ফিরে যেতে বলা হয়।
ভুক্তভোগী বাংলাদেশি তৃতীয় ব্যক্তিও একই ফাঁদে পড়েছিলেন। এস অক্ষর দিয়ে নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করে অরণ্য নামে এক ব্যক্তি ভারতে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এমনকি প্রশিক্ষণের সময় বৃত্তিও দেওয়া হবে বলে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল।
আর সেই প্রলোভনে পড়ে ভারতে পৌঁছানোর পর তার বেশ কিছু মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়। এরপর একইভাবে তার কিডনিও অস্ত্রোপচার করে বের করে নেওয়া হয়। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি বলেছেন, মাত্র ৬ দিনে তার শরীর থেকে ৪৯ টিউব রক্ত টানা হয়েছিল।
অবিশ্বাসে রঞ্জিত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাকে এমন কিছু দেওয়া হয়েছিল যার ফলে প্রথমে আমি দুর্বল বোধ করি এবং একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার কিডনি নেই। আমাকে বলা হয়েছিল আমি কোনো সমস্যা ছাড়াই একটি কিডনি নিয়ে বাঁচতে পারব। পরে আমাকে সাড়ে চার লাখ টাকা দেওয়া হয়।’
এদিকে এই তিন বাংলাদেশির অভিযোগের ভিত্তিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অধীনে একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। চার্জশিট দাখিল করে তারা শুনানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা ইতোমধ্যেই তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন।
এছাড়া সম্প্রতি, অঙ্গ পাচারের বেআইনি ব্যবসা নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ট্রান্সপ্লান্টেশন অব হিউম্যান অর্গান অ্যান্ড টিস্যুস অ্যাক্ট, ১৯৯৪-এর ১৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, এই ধরনের অপরাধে ২০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং ৫ বছর থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।