ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস: আজো অঝরে কাঁদেন নিহতদের পরিবার


কংকনা রায়, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি: , আপডেট করা হয়েছে : 25-08-2024

ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস: আজো অঝরে কাঁদেন নিহতদের পরিবার

২০০৬ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে কয়লাখনি বিরোধী আন্দোলনের পুলিশ ও তৎকালিন বিডিআরের গুলিতে নিহত হন তরতাজা যুবক মো. আমিনুল ইসলাম আমিন, মো. সালেকিন ও আবু সালেহ মো. তরিকুল ইসলাম। তাদের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে যারা বেঁচে আছেন তাদের পরিবার, কেমন আছেন তারা? খোঁজ নেওয়ার যেন কেউই নেই। শুধুমাত্র দিবসেই কদর বাড়ে নিহতদের পরিবারগুলোর। একই অবস্থা এ ঘটনায় আহত হওয়া দু’শতাধিক নারী-পুুরুষেরও।

নিহতদের মধ্যে আবু সালেহ মো. তরিকুল ইসলাম সম্ভ্রান্ত পরিবারের হলেও বাঁকি দু’জন মো. আমিনুল ইসলাম আমিন ও মো. সালেকিন ছিলেন দুস্থ ও অসহায় পরিবারের সন্তান। মো. আমিনুল ইসলাম আমিন ও মো. সালেকিন শিক্ষার্থী থাকলেও আমিন ছিলেন তার পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমিন ও সালেকিনকে হারিয়ে তাদের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এদিকে প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় সালেকিনের মা শেফালী বেগম অপরদিকে খরচ দিতে না পাড়ায় পড়ালেখা ছাড়লেন আমিনের ভাই আল আমিন। পরিবারগুলোর দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতি অনেকে দিলেও বাস্তবে এখন তাদের দেখা মিলে না। মিলে না কোনোপ্রকার সহযোগিতা। এমনি আক্ষেপ এখন নিহতদের পরিবারগুলোর।

সেইদিন যা ঘটেছিল: জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে ফুলবাড়ী কয়লাখনির কয়লা উত্তোলনের চক্রান্ত বন্ধের দাবিতে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ওইদিন বহুজাতিক কোম্পানী এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়। ওই কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনে যোগ দেয় ফুলবাড়ী সম্মিলিত পেশাজীবী সংগঠন। কয়লাখনি এলাকা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর ও নবাবগঞ্জ এই চার উপজেলার কয়লাখনি বিরোধী মানুষ দলবব্ধ হয়ে সেদিন বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এশিয়া এনার্জির কার্যালয় ঘেরাও করতে যান। ফুলবাড়ী ছোট যমুনা সেতুর পূর্বপাশে পুলিশ এবং তৎকালিন বিডিআর ওই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই আমিন, সালেকিন ও তরিকুল ইসলাম নিহত হন।

কেমন আছে আমিনের পরিবার?

ফুলবাড়ী পৌরএলাকার বারোকোনা গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে মো. আমিনুল ইসলাম আমিন। চার ভাইবোনের মধ্যে আমিনই ছিলেন বড়। ছোট বোন হানিফা বেগম, ছোট ভাই আল আমিন ও সর্বকনিষ্ঠ বোন হুমাইরা আফরিন। আমিনের বাবা কৃষি কাজ করে সংসার চালানোসহ চালাতেন আমিনের ছোট ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ। আমিন পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। বাবার পাশাপাশি তিনিও সংসারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ২০০৬ সালে আমিনের বয়স ছিল ১৪ বছর। দেশের মাটি রক্ষার্থে সকলের মতো আমিনও বাড়ি থেকে মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে মিছিলে বেড়িয়ে পড়েন। মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু হলে দুর্ভাগ্যক্রমে আমিনের শরীর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আমিন।

আমিনের মা রেহেনা বেগম অশ্রুচোখে বলেন, ছেলে দেশের মাটি রক্ষা করতে আন্দোলনে গেল কিন্তু আর ফিরে এলো না। আমরা ওইদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করে তাকে পাচ্ছিলাম না। পরে রাতে দিনাজপুর মেডিকেল হাসপাতালে তার মরদেহ পেয়েছি। আমিন ছোট থেকেই কর্মঠ ছিল। সে পরিবারের দুর্দশার কথা চিন্তা করে পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতো। কৃষক বাবার অর্থের পাশাপাশি তার অর্থ দিয়ে সংসার চালানোসহ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো হতো। কিন্তু ঘাতকদের গুলিতে সন্তান হারিয়ে আজ আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমার বৃদ্ধ স্বামীর কষ্টের টাকায় সংসার চলে কোনো মতে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ ও সংসারে খরচ চালানো তার পক্ষেও আর সম্ভব হচ্ছে না। পড়ালেখার খরচ ও বই কিনে দিতে না পারায় ছোট ছেলে আল আমিন চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। সে আর কলেজে যায় না। সেও এখন তার বাবার সাথে জমিতে কাজ করছে। আমিন মারা যাওয়ার পর ধারদেনা করে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আমাদের এতো কষ্টে দিন কাটাতে হতো না। ছোট ছেলের লেখাপড়া বন্ধ হতো না। আমিন মারা যাওয়ার পর অনেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ছোট ছেলেকে চাকরি দেয়ার আশ^াস দিয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।

কেমন আছে সালেকিনের পরিবার?

নবাবগঞ্জ উপজেলার জয়পুর ইউনিয়নের ঝোড়ারপাড়া গ্রামের হাসেন আলীর ছেলে মো. সালেকিন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সালেকিন ছিল তৃতীয়। বড়ভাই সোলেমান, এরশাদ ও ছোট বোন হাসিনা ও সর্বকনিষ্ঠ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই শাহিন। সালেকিনের বাবা হাসেন আলী একজন কৃষক। তিনি অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালান। ২০০৬ সালে সালেকিন সবে প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক জীবন শুরু করেছিল। গ্রামের সবাইকে আন্দোলনে যেতে দেখে সালেকিনও উৎসাহিত হয়ে ফুলবাড়ী আসেন আন্দোলনে। চাচার সাথে ফুলবাড়ী আসলেও পরবর্তীতে দুলাভাইয়ের সাথে আন্দোলনে থাকেন। চারিদিকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে সেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সালেকিন!

সালেকিনের মা শেফালী বেগম আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, স্কুল থেকে ফিরেই, না খেয়েই ফুলবাড়ীতে যায় সালেকিন। তাকে অসংখ্যবার বললাম সেখানে গণ্ডগোল হবে যাস না। কিন্তু তবুও সে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে। আমি পথ চেয়ে রইলাম। সালেকিন বাড়ি ফিরল ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। সালেকিন মারা যাওয়ার পর ২০১১ সালে ধারদেনা করে মেয়ে হাসিনাকে বিয়ে দেই। বর্তমানে আমি, আমার স্বামী ও প্রতিবন্ধী ছেলে শাহিন একখানে বাস করি। বাকি ছেলেরা বিয়ে-শাদি করে ভিন্ন হয়ে গেছে। বড় ছেলে সোলেমান থাকেন তার নানা বাড়িতে। তিনি সেখানেই ছোট থেকে বড় হয়ে নিজ সংসার গড়েছে। বর্তমানে আমার বৃদ্ধ স্বামী কোনোমতে মানুষের বাড়িতে কাজ করে আমাদেরকে খাওয়াচ্ছেন। প্রতিবন্ধী ছেলেকে রেখে আমিও যেতে পারিনা কাজে। সবাই শুধু ২৬শে আগস্ট আসলেই আমাদের খোঁজখবর নেয়। কেউ তো আমাদের জন্য কিছু করে না। সালেকিন মারা যাওয়ার পর অনেকে শুধু আশ্বাস দিয়ে গেছেন। আমার বৃদ্ধ স্বামী বিছানায় পড়ে গেলে আমাদেরকে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে।

সালেকিনের চাচা জবেদ আলী বলেন, আমার সাথেই আমার ভাতিজা সালেকিন আন্দোলনে গেলেও পরবর্তীতে তার দুলাভাইয়ের সাথে ছিল সে। পরে গোলাগুলি শুরু হলে সবাই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ি। কেউ কারো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। পরে এলাকার লোকজন আমাকে এসে বলে সালেকিনকে গুলি লেগেছে। পরে আমরা ছুঁটে গিয়ে দেখি সড়কে তার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে।

কেমন আছে তরিকুলের পরিবার?

ফুলবাড়ী পৌরএলাকার উত্তর সুজাপুর (চাঁদপাড়া) গ্রামের সাবেক পৌর কাউন্সিলর মুকলেছুর রহমানের ছেলে আবু সালেহ মো. তরিকুল ইসলাম। তিনভাইয়ের মধ্যে তরিকুল ছিলেন বড়। তার ছোট ভাই সাদ্দাম হোসেন ও তৌকির আহম্মেদ তপু। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে তরিকুল রাজশাহীর নিউ গর্ভমেন্ট কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা মুকলেছুর রহমান ২০০৬ সালে পৌরকাউন্সিল ছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি জমিতে চাষআবাদ ও একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। ২০০৬ সালের খনিবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন এলাকা থেকে জনঢল নামা দেখে তরিকুল তার ছোটভাই সাদ্দাম হোসেনকে নিয়ে আন্দোলন দেখতে গেলেও সাদ্দাম জীবিত ফিরলেও তরিকুল জীবিত ফিরে আসেনা। পুলিশ-বিডিয়ারে ছোঁরা গুলিতে প্রাণ হারায় সে।

তরিকুলের বাবা সাবেক পৌর কাউন্সিলর মোকলেছুর রহমান বলেন, ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার তরিকুল রাজশাহী থেকে ফুলবাড়ী আসতে চায়। পরে তার মা তহমিনা রহমান তাকে আসতে বাঁধা দিলেও আমি তাকে আসতে বলি। তাকে আসতে বলাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। সে যদি সেইদিন ফুলবাড়ীতে না আসতো, তবে আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকতো। তারা দুইভাই শহরে আন্দোলন দেখতে যায় দুপুরে। বিকালে আমার কাছে ফোন আসে আপনার ছেলেরা কোথায়? বুঝতে পারি তাদের কোনো বিপদ হয়েছে। পরে খবর পাই, সে আর নেই। পরের দিন তার মরদেহ দিনাজপুর থেকে নিয়ে আসি। তরিকুলের বন্ধু-বান্ধবরা আজ আমাদের চোখের সামনে চাকুরি করছে। আমার ছেলে থাকলে সেও আজ ভালো কোনো চাকুরি করতো।

ছেলেদের হারিয়ে দুটি পরিবার এখন চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। পরিবারগুলোর দাবি: প্রতিবছর ২৬ আগস্ট শুধুই দিবসে পরিণত হলেও, যাদের রক্তের বিনিময়ে ফুলবাড়ী রক্ষা পেল। তাদের পরিবারের খোঁজখবর নেওয়ার যেনো কেউ নেই। বৃষ্টির পানির মতো আজো তিন শহিদ যুবকের মায়েদের চোখ থেকে ঝরে কান্না। ছেলেদের কথা মনে পড়লে যেনো তাদের জীবনে কালো মেঘে ছেঁয়ে যায়।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]