মুসলমানের জন্য যে প্রস্তুতি রমজানজুড়ে রহমত, বরকত, মাগফেরাত, নাজাত ও যাবতীয় কল্যাণের দরজা খুলে রাখবে। তবে রমজানের প্রস্তুতি মানেই খাবারের সমাহার সংগ্রহের প্রস্তুতি নয়; বরং আত্মিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করা। যদিও মানুষ আত্মিক প্রস্তুতি বাদ দিয়ে খাবারের আয়োজনেই বেশি ঝুঁকে পড়ে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর কোনো বান্দা যে কোনো ভালো কাজ বা আমল যদি যথাযথভাবে উত্তম উপায়ে করে; তবে সে আমল বা কাজ আল্লাহ তাআলা পছন্দনীয় হিসেবে গ্রহণ করেন।’ (তাবারানি)
সুতরাং রমজানের আমল বা কাজ যেনতেনভাবে নয়; বরং পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আদায় করতে হবে। তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। আর এতে রমজানের আগাম ১১টি প্রস্তুতিমূলক বিষয় রয়েছে। তা হলো-
তাওবাহ-ইসতেগফার করা: রমজানের আগের সব গোনাহ থেকে তাওবাহ ইসতেগফার করতে হবে। কোনো অন্যায়কারী যদি ভাবেন, রমজান চলে এসেছে, আর আমার সব গোনাহ এমনিতেই ক্ষমা হয়ে যাবে। বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়। বরং আগে থেকে তাওবাহ-ইসতেগফার করে রমজানের যাবতীয় কল্যাণ লাভে নিজেকে প্রস্তুত করা খুবই জরুরি। আর তাতে আল্লাহ তাআলা ওই বান্দার আগের সব গোনাহ মাফ করে দিয়ে রমজানের যাবতীয় কল্যাণ দিয়ে জীবন সুন্দর করে দেবেন। এ জন্য বান্দা বেশি বেশি পড়বে- اَللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ : আল্লাহুম্মাগফিরলি, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন।
রমজানের উপকারিতা স্মরণ করা: বরকতময় মাস রমজান সম্পর্কে কুরআন-সুন্নায় যেসব ফজিলত, মর্যাদা ও উপকারিতার বর্ণনা রয়েছে, রমজান শুরু হওয়ার আগেই সেসব সম্পর্কে জেনে নেওয়া। সেসব উপকার পেতে কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলার প্রস্তুতি নেওয়া। রমজান আসছে, মানসিকভাবে বারবার এ কথা স্মরণ ও নেক আমলের প্রস্তুতি নিতে দোয়াটি বেশি বেশি করা- اَللَّهُمَّ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ : আল্লাহুম্মা বাল্লিগনা রামাদান। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন। অর্থাৎ রমজান পর্যন্ত হায়াত দান করুন।’
মানসিক প্রতিজ্ঞা নেওয়া: রমজান মাসে পরিপূর্ণ সাওয়াব ও ক্ষমা পেতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া। জীবনভর যত গোনাহ করেছি এ রমজানে সেসব গোনাহ বা অন্যায় থেকে পরিপূর্ণ ক্ষমা পেতে হবে। সবচেয়ে বেশি সাওয়াব পেতে হবে। রমজান শুরু হওয়ার আগে এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা জরুরি। অনেক সময় পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় রমজান পেয়েও মুসলমান পরিপূর্ণ সাওয়াব ও ক্ষমা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তাই প্রতিজ্ঞা এমনভাবে করা, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা নিজের কাজ যেমনই হোক, আমি আমার বিগত জীবনের সব গোনাহ থেকে নিজেকে মাফ করিয়ে নেব। আমার প্রতি আল্লাহকে রাজি-খুশি করিয়েই ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ।
কাজা রোজা আদায় করা: রমজান শুরু হওয়ার আগে বিগত জীবনে অসুস্থ হওয়ার কারণে বা সফরের কারণে রমজানের ফরজ রোজা কাজা হয়ে থাকলে তা যথাযথভাবে আদায় করে নেওয়া। বিশেষ করে মা-বোনদের ভাঙতি রোজা থাকতে পারে। তাই রমজানের আগে শাবান মাসের এ সময়ে কাজা রোজা আদায় করে নেওয়া। এতে দুটি ভালো আমল বাস্তবায়িত হবে। প্রথমত, বিগত জীবনের কাজা রোজা আদায় হবে। রমজানের রোজা পালনের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, সুন্নাতের অনুসরণ হবে। রমজানের আগের মাস শাবানে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেশি বেশি নফল রোজা রাখতেন। রমজানের প্রস্তুতি নিতে। কাজা রোজা আদায় করার মাধ্যমে সুন্নাতের অনুসরণও হয়ে যাবে।
সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার চেষ্টা করা: আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে অনেক মানুষকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে এ সাধারণ ক্ষমা সবার ভাগ্যে জোটে না। এ ক্ষমা পেতে হলে দুটি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করে তা থেকে ফিরে আসতে হবে। তা হলো- শিরক থেকে মুক্ত থাকা। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক না করা। কেউ ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায়, ছোট বা বড় শিরক করে থাকলে রমজান আসার আগেই তা থেকে তাওবাহ-ইসতেগফারের মাধ্যমে ফিরে আসা। আর হিংসা থেকে মুক্ত থাকা। কারো প্রতি কোনো বিষয়ে হিংসা না করা। কারণ হিংসা মানুষের সব নেক আমলকে সেভাবে জ্বালিয়ে দেয়; যেভাবে আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে দেয়। তাই হিংসা পরিহার করে মনকে ক্ষমা লাভে স্বচ্ছ রাখা।
ফরজ রোজার নিয়ম-কানুন জানা: রমজান আসার আগে রোজা পালনের মাসআলা-মাসায়েল তথা নিয়ম-কানুনগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি। তাতে রমজানের রোজা নষ্ট হওয়া বা মাকরূহ হওয়া বা অন্য বিষয়গুলো জেনে নেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
বিগত রমজানের অসমাপ্ত কাজ
রমজান মাস আসার আগে বিগত রমজানের নেক আমলগুলো করতে না পারার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। যেমন-
১. কেন নিয়মিত কুরআন অধ্যয়ন করা হয়নি?
২. কেন তারাবিহ পড়া হয়নি?
৩. কেন দান-সহযোগিতা করা হয়নি?
৪. কেন ইতেকাফ করা হয়নি?
৫. কেন রোজাদারকে ইফতার করানো হয়নি?
৬. কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাআতের সাথে আদায় করা সম্ভব হয়নি?
৭. কেন কুরআন-সুন্নার আলোচনায় বসা হয়নি?
৮. কেন রমজানে পরিবারের হক আদায় করা হয়নি?
৯. কেন পাড়া-প্রতিবেশি বা আত্মীয়দের হক আদায় করা হয়নি?
বিষয়গুলো চিহ্নিত করে নেওয়া। এ বছর রমজান আসার আগে আগে চিহ্নিত কারণগুলো থেকে নিজেকে বিরত রেখে কিংবা প্রস্তুতি নিয়ে কল্যাণকর সব নেক আমলগুলো করার প্রস্তুতি নেওয়া।
শাবান মাসে রমজানের মহড়া চালু রাখা: রমজান মাসে বেশি বেশি ইবাদত করতে এবং রোজা রাখার জন্য শাবান মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা। বেশি বেশি কুরআন অধ্যয়ন করা। নফল নামাজ পড়া। তাওবাহ-ইসতেগফার করা। ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা। দান-সাদকাহ শুরু করা। যাতে এ মহড়ার বাস্তবায়ন রমজানজুড়ে সুন্দরভাবে চালানো যায়।
রোজায় ২৪ ঘণ্টার রুটিন করা: রমজান মাসজুড়ে যে কাজেই থাকুন না কেন, পুরো সময়টি কোন কোন কাজে কীভাবে ব্যয় হবে; তার একটি সম্ভাব্য রুটিন তৈরি করে নেওয়া। আগাম রুটিন থাকলে রমজানে চরম ব্যস্ততার মাঝেও নেক আমলসহ অন্যান্য কাজও ইবাদতের মধ্যেই কেটে যাবে। এক কথায় সব কাজের তালিকা করে নেওয়া।
রমজানের চাঁদের অনুসন্ধান: শাবান মাসের ২৯ তারিখ সন্ধ্যায় চাঁদের অনুসন্ধান করা সুন্নাত। মুছে যাওয়ার পথে থাকা সুন্নাতটিকে আবারও জীবিত করার পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা। বর্তমানে চাঁদ দেখা কমিটির দিকে তাকিয়ে থাকার রীতি চলছে। মোবাইল, রেডিও ও টিভির সংবাদের অপেক্ষা করেন। এতে চাঁদ দেখা এবং দোয়া পড়ার সুন্নাতটি থেকে বঞ্চিত হয় মুসলমান। এ থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদ অনুসন্ধান করার সুন্নাতটি জীবিত করার সর্বাত্মক পূর্বপ্রস্তুতি রাখা।
বেশি বেশি দোয়া: রমজানের আগে আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করা। হে আল্লাহ! আমি যতই চেষ্টা করি, তোমার তাওফিক বা ইচ্ছা না থাকলে আমি যেমন রমজান পাবো না। আবার রমজান পেলেও বরকত লাভে সক্ষম হবো না। সুতরাং রমজান ও রমজানের নেক আমল করার ক্ষমতা তোমার কাছে চাই। হে আল্লাহ! রমজানে যত মানুষ সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লেখাবে, তাদের কাতারে আমাকেও শামিল করো; হে রাব্বুল আলামিন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের আগের প্রস্তুতিসমূহ যথাযথভাবে বেশি বেশি বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
রাজশাহীর সময়/এএইচ