ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ এক নগরী রাজশাহী। ১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে আন্দোলনে প্রথম রক্ত ঝরেছিল রাজশাহীতে। ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর মোহন পার্কে আয়োজিত হয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের দাবিতে ১ম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ভাষা আন্দোলনের মিছিলে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহিদ ছাত্রদের স্মৃতিতে ১ম শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছিলো রাজশাহীতেই। ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজশাহী কলেজ মুসলিম হোস্টেলের এফ ব্লকের সামনে ইট-কাদা দিয়ে নির্মিত এই স্মৃতিস্তম্ভটিই ছিলো দেশে ভাষা আন্দোলনের ১ম শহিদ মিনার।
কিন্তু ভাষার আন্দোলনের স্মৃতিময় এই নগরী ও জেলার ৫৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো শহিদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ। শিক্ষার্থীরাও ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানাতে পারে না। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী শহিদ মিনার বানিয়ে জানানো হয় শ্রদ্ধা।
রাজশাহী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার এক হাজার ৫৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৮১টিতে নেই শহিদ মিনার। এবং ৯০৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৩২টিতে আছে শহিদ মিনার। তথ্যে দেখা যায়, জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে বাগমারায় সবচেয়ে কম শহিদ মিনার আছে।
এই উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি ২২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১০টি আছে শহিদ মিনার। ১৬২টি সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টিতে আছে শহিদ মিনার।
শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা বলছেন, স্কুলগুলোতে শহিদ মিনার না থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থ। এছাড়া অনেক স্কুলে নেই শহিদ মিনার বানানোর মতো পর্যাপ্ত যায়গা। অর্থ বরাদ্দ পেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহিদ মিনার বানানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।
বাগমারার মোহম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খন্দকার মো. জাহেদুর রহমান বলেন, অর্থের অভাবে স্কুলে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা থেকে অর্থ বরাদ্দ মিলছে না। তাই আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে অস্থায়ী ভাবে শহিদ মিনার বানিয়েছি। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবো।
উপজেলার চানপাড়া আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাজমা খাতুন বলেন, বিদ্যালয় চত্বরে শহীদ মিনার স্থাপনের কোনো অর্থ নেই। এনিয়ে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো সাড়া দেয়নি। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন যায়গায় গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসে।
রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে শহিদ মিনার নেই। এর মধ্যে সাবিত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাবিত্রী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমি বালিকা শাখা, রেলওয়ে স্টেশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গৌরহাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাদিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোতে যেমন পর্যাপ্ত জায়গা, খেলার মাঠ নেই, তেমনিভাবে নেই শহিদ মিনারও। ফলে গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের শহিদ মিনারে যান শিক্ষকরা। আবার কখনো অস্থায়ী শহিদ মিনারেই করা হয় শ্রদ্ধা নিবেদন। ফলে শহিদ মিনার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ধারণা যেমন অস্পষ্ট, তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না শিশুরা।
মসজিদ মিশন অ্যাকাডেমি বালিকা শাখার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিকা ইবনাত বলেন, আমাদের এই শাখায় শহিদ মিনার নেই। থাকলে আমরা স্কুলেই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম। শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের যেতে হয় বালক শাখায়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেভাবে দিবসগুলোতে আলাদা করে কোনো অনুষ্ঠানও করা হয় না।
কাদিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহারা নাসরিন বলেন, স্কুল প্রাঙ্গণে শহিদ মিনার স্থাপনের জন্য জায়গা না থাকায় ত শ্রদ্ধা জানাতে অন্য স্কুলে যেতে হয়। আমাদের এই বিদ্যালয়ের খেলার মাঠও নেই।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার স্থাপনের প্রধান প্রতিবন্ধকতা অর্থের অভাব। শহিদ মিনার নির্মাণে আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো বরাদ্দ পায় না। বরাদ্দ পেলে সব বিদ্যালয়ে আমরা শহিদ মিনার তৈরি করবো।
রাজশাহী জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।