তরুণদের মুখোমুখি হয়ে সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা তুলে ধরলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সরকারি সব কাজ ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে করব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। স্মার্ট সরকার হবে। পাশাপাশি আমাদের অর্থনীতিও স্মার্ট হবে।
আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সিআরআই (সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন) আয়োজিত ‘লেটস টক’ অনুষ্ঠানে গত শুক্রবার এসব তরুণের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
অনুষ্ঠানে জানতে চাওয়া হয়, পুরো বাংলাদেশ থেকে তরুণ-তরুণীরা হাজির হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজ কেমন লাগছে আপনার এই অনুষ্ঠানে এসে?
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক ধন্যবাদ এই সুযোগ দেওয়ার জন্য।
আমি এটুকুই বলব, আসলে আমার নাতি-নাতনিরা তাদের মা-বাবার সঙ্গে বিদেশে থাকে। আমি তাদের পাই না। তো আমি আজ একঝাঁক নাতি-নাতনি পেলাম এই অনুষ্ঠানে এসে।
স্মার্ট বাংলাদেশ মানে কী এবং এ নিয়ে তাঁর স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরাতো আসলে কম্পিউটার শিক্ষাটা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জোর দিচ্ছিলাম।
আমরা চাচ্ছিলাম, আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তি শিক্ষাটা নেয়। তখন বিজ্ঞানের প্রতি এত আগ্রহ ছিল না। আমরা কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করে ফেলেছি। আমরা সারা বাংলাদেশ ব্রডব্যান্ড কানেকশন দিচ্ছি। স্যাটেলাইট উৎক্ষপণ করেছি।
এ ছাড়া এখন ওয়াই-ফাই কানেকশন সারা বাংলাদেশে। আমরা ৪জি ব্যবহার করছি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভেল্টের জন্য ৫জির দিকে যাচ্ছি। এসব কাজ আমরা করে ফেলেছি। তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে? সেখানেও আবার আমার ছেলে বুদ্ধি দিল যে আমরা এবার স্মার্ট বাংলাদেশ করব। স্মার্ট বাংলাদেশের কনসেপ্ট হলো যে আমাদের যারা ছেলেমেয়ে আছে তারা শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানে এবং প্রযুক্তি বিজ্ঞানে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। পাশাপাশি সরকারকেও স্মার্ট সরকার গঠন করতে হবে। প্রথম সরকারে এসে দেখেছি একটি কম্পিউটার সাজানো আছে। ওটা কেউ ছুঁয়ে দেখে না। কিন্তু এখন তো আর সেটা না। আমাদের সব মোবাইল ছিল অ্যানালগ। একটা ফোনের দাম ছিল এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। আমি যখন সরকারে এলাম তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এটাকে উন্মুক্ত করে দেব। তখন আমরা বেসরকারি সেক্টর উন্মুক্ত করে দিলাম। এখন মোবাইল ফোন সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। সেই সঙ্গে কম্পিউটার ব্যবহার। স্কুল থেকে শুরু করে দিলাম। ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ছেলেমেয়েদের শেখানো শুরু করলাম। আমরা চাচ্ছি আমাদের সরকারের সব কাজ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে করব, যাতে স্মার্ট জনগোষ্ঠী, স্মার্ট সরকার এবং আমাদের ইকোনমিও হবে স্মার্ট ইকোনমি। অর্থাৎ আমরা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কাজগুলো চালাব। এতে আমাদের কর্মঘণ্টা বাঁচবে।
তিনি আরো বলেন, আমি চাই আমাদের সোসাইটির সবাই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করুক। এখন তো পেনশন থেকে শুরু করে বিল দেওয়া পর্যন্ত সব কাজ অনলাইনে করছে। এমনকি আমি যে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি করেছিলাম তা আমরা সেগুলো অনলাইনে দিয়ে দিই। এখন আমাদের ছয় লাখ ৮০ হাজার ছেলেমেয়ে ফ্রিল্যান্সিং করে অর্থ উপার্জন করে।...৪১-এ বাংলাদেশে আমাদের সব ছেলেমেয়ে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করবে এবং যত প্রযুক্তি আসবে তা শিখে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, নারী-পুরুষ ট্রান্সজেন্ডার যারাই হোক সবাই আমাদের সন্তান। প্রতিটি পরিবার তাদের গ্রহণ করবে। আমি চাই তারাও একটা অধিকার নিয়ে সমাজে দাঁড়াবে এবং সেইভাবে কাজ করবে। সেই অবস্থাটাই আমরা সৃষ্টি করেছি। সেভাবে আমি স্বীকৃতি দিয়েছি।
ট্যুরিজম সেক্টর নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা বাংলাদেশের ট্যুরিজম সেক্টর নিয়ে তাঁর স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চা-বাগান থেকে শুরু করে আমাদের সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতটা হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ একটি সমুদ্রসৈকত। এই সৈকত ডেভেলপ করার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। কক্সবাজার নিয়ে আমার ইচ্ছা আছে আমরা যদি বিদেশি পর্যটক আনতে চাই সেটার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা। আমার একটি প্ল্যান আছে যে আমরা বাইরের কোনো দেশকে একটি অংশ দেব তারা ওখানে ইনভেস্ট করবে। সেটা শুধু বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তাহলে বিদেশি পর্যটকরা আমাদের দেশে আসবে। এখনো আসে, কিন্তু তারা ওই সুযোগটা পায় না। আরেকটি বিষয় নিয়ে নেপালের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। যৌথভাবে কিভাবে ট্যুরিজমটা উন্নত করা যায়, সেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এমনকি মালদ্বীপের সঙ্গেও আমরা নৌভ্রমণের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা করে যাচ্ছি, তবে আমাদের আরো পরিকল্পিতভাবে করতে হবে। আর তোমাদের মতো তরুণ প্রজন্মও এ নিয়ে ধারণা দাও।
মানবাধিকার ইস্যু ও যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ইস্যুতে মার্কিন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন ১৯৯৬ সালে সরকারে আসি তখন ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডার দিয়ে অনেক কম্পানি আসে। আমেরিকান কম্পানিও এখানে তখন গ্যাস উত্তোলন করে। তখন একটি প্রস্তাব এলো যে এই গ্যাস বিক্রি করে দিতে হবে। আমি এতে আপত্তি করলাম। সেই আপত্তি করার খেসারত আমাকে দিতে হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আমাকে আসতে দেওয়া হয়নি। আমার দেশের ভেতর আর বাইরের চক্রান্ত এক হয়ে গেল। তো এ রকম কিছু ব্যাপার আছে। এরা সব সময় হস্তক্ষেপ করতে চায়। আজ মানবাধিকারের কথা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো নিজের দেশের দিকে তাকায় না, জাতিসংঘে আমি ফিলিস্তিন ইস্যুটা তুলেছিলাম। ইইউতেও আমি যখন গেলাম তখন খুব শক্তভাবে প্রশ্নটা তুলেছিলাম, ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের মারা হচ্ছে, এখন কেন সবাই চুপ? এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দুই-দুইবার যুদ্ধ বন্ধের জন্য যে প্রস্তাব আসে তাতে আমেরিকা ভেটো দিল। আমেরিকায় মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু তারা অন্য জায়গায় এসে খবরদারি করে। এই মোড়লিপনা যে তাদের কে করতে দিল আমি সেটা জানি না। আমি এই বিষয়টা সবার আগে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরেছি এবং প্রতিবাদও করেছি।
জলবায়ুর ঝুঁকি নিয়ে পরামর্শএক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমি আমাদের যুবসমাজকে বলব যে যেখানে পারবেন একটি করে গাছ লাগাবেন। আমাদের যুবসমাজের কাছে এটাই আমার আহ্বান থাকবে যার যেখানে যতটুকু জায়গা আছে গাছ লাগাতে হবে। পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে আর উৎপাদন করতে হবে। জলবায়ু ইস্যুতে অনেক প্রমিস করা হয়। কিন্তু যারা আসলে ডেভেলপ হয়েছে যারা সবচেয়ে বেশি দূষণ করে তারা খবরদারি করে অন্যের ওপর। আমাদের তো কার্বন নিঃসরণ নেই। তার পরও আমরা সচেতন।
আমি গ্রামেই থাকব গ্রামের অভিজ্ঞতার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমার জন্ম গ্রামে। ঢাকা থেকে আমাদের গ্রাম টুঙ্গিপাড়া যেতে ২২ থেকে ২৪ ঘণ্টা লাগত স্টিমারে। আমি আট বছর পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় আসি। তবে প্রত্যেক স্কুল ছুটিতে গ্রামে যেতাম। তখন বিদ্যুৎ ছিল না, খাল-পুকুরের পানি ব্যবহার করতাম। ওগুলোই আমাদের জন্য আনন্দের ছিল। আমার ঢাকায় কোনো বাড়িঘর নেই। আমি গ্রামেই থাকব। এখন তো পদ্মা সেতু হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চলে যাব।