পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। সংস্থাটি এখন পায়রায় একই সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। যৌথভাবে কয়লাভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎ নির্মাণ করছে চীনা কোম্পানি নরিনকো ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল)। এটিরও সক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট।
পায়রাতেই ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল)। এরই মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরই উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার কথা রয়েছে।
দেশে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতা এখন প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট। যদিও দেশে এখন পর্যন্ত দৈনিক বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার উঠেছে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। পায়রার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মাণ শেষ হলে দেশের গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরো ৩ হাজার ৮৪০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে হবে আমদানিনির্ভর জ্বালানি কয়লা ও এলএনজি ব্যবহার করে। এতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) আর্থিকভাবে আরো চাপে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংস্থাটির কাছে এরই মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুতের বিল বাবদ পাওনা বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে রয়েছে। জ্বালানি আমদানিতে অর্থ সংকটের কারণে চলতি বছরেই কয়েক দফায় বন্ধ রাখতে হয়েছে পায়রা, রামপালসহ বেসরকারি খাতের কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আবার চাহিদা ও গ্যাস সংকটে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না গ্যাসভিত্তিক বড় তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে মোট সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর সবগুলোই বেইজ লোডভিত্তিক (সার্বক্ষণিক চালু)। নির্মাণ শেষে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানি সংস্থানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে রিজার্ভ সংকট ও বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামে অস্থিতিশীলতা।’
বিসিপিসিএল সূত্রে জানা গেছে, পায়রায় সংস্থাটির দ্বিতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ২১ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার প্রকল্পের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন করছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির আর্থিক কার্যক্রমের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কাজও জোরালোভাবে এগিয়ে চলছে।
সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট (৬৬০ মেগাওয়াট) ২০২৪ সালের মে মাসে এবং দ্বিতীয় ইউনিট একই বছরের জুনে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। যদিও বিপিডিবি ২০২৪ সালের নভেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয় ইউনিটে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমাদের পায়রায় আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি উৎপাদনে রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে একই সক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের অগ্রগতির হার ২১ শতাংশ। এছাড়া গ্যাসের আমদানি বাড়া সাপেক্ষে আরেকটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।’
নরিনকো ও আরপিসিএলের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে গৃহীত প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি মাস পর্যন্ত এর ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ। আর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আগামী বছরের জুন নাগাদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ও অক্টোবর নাগাদ দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে যাওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ও দ্বিতীয় ইউনিটের বয়লার, চিমনি, পাওয়ার হাউজসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানির জাহাজ চলাচলের জন্য জেটি নির্মাণকাজ এবং কোল কনভেয়ার বেল্ট ও সঞ্চালন টাওয়ার কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালুর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সবুর বলেন, ‘শিডিউল অনুযায়ী আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ হবে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কয়লা আমদানির প্রথম চালান জাহাজীকরণ হবে। আমরা এরই মধ্যে প্রকল্পের কিছু কাজের প্রি-কমিশনিং শুরু করেছি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্মিত সঞ্চালন লাইনের কাজও ৮০ শতাংশ শেষ।’
আরপিসিএল-নরিনকোর যৌথ বিনিয়োগে নির্মীয়মাণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ব্যয় হচ্ছে আড়াই বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের অর্থায়ন হচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের মাধ্যমে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা করবে আরপিসিএল-নরিনকোর যৌথ মালিকানায় গঠিত কোম্পানি আরএনপিএল।
দেশে এলএনজি আমদানি বাড়ার সম্ভাবনা থেকে পায়রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বড় একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে এনডব্লিউপিজিসিএল। এরই মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে। আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিপিডিবি।
এনডব্লিউপিজিসিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ ও অর্থায়নের বিষয়টি জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংস্থাটির শীর্ষ এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটি নিয়ে তৎপরতা এখন পর্যন্ত তেমন একটা জোরালো হয়ে ওঠেনি। তবে পায়রায় এলএনজি টার্মিনাল হলে সেখানে এনডব্লিউপিজিসিএলের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হবে। তখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জ্বালানির বড় একটি উৎসও তৈরি হবে।’
দেশে চলতি বছরেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের বৃহৎ সক্ষমতার কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এরই মধ্যে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে জাপানি অর্থায়নে নির্মিত ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বেসরকারিভাবে নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎও এখন গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছে। এর বাইরে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্স গ্রুপের গ্যাসভিত্তিক বড় তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র।