এক সপ্তাহ আগে উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের দখল নিয়েছিল ইসরাইলি বাহিনী। অভিযোগ, দিনের পর দিন তারা রোগীদের খেতে দেয়নি। পানিটুকুও দেয়নি। বাহিনী চলে যেতে এখন দেখা যাচ্ছে, চার দিকে রোগীদের আধপোড়া দেহ। কারো শরীরে শেষ প্রাণবায়ুটুকু আটকে আছে। ফিলিস্তিনিদের দাবি, বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে রোগীদের।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইল যেন আরো বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। অভিযোগ, তারা বেছে বেছে গাজার হাসপাতাল ও বসতি এলাকাগুলোকে নিশানা করছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জাবালিয়া ও নুসেরাত শরণার্থী শিবিরের। গাজা শহরের শুজেয়া, টুফা ও দারাজ অঞ্চলেও টানা গোলাবর্ষণ চলছে। আল-শিফা হাসপাতালে লাগাতার গুলি চলছে। অন্তত ২৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সেও গত ৪৮ ঘণ্টা ধরে গোলাবর্ষণ চলছে। তবে সবচেয়ে শিউরে ওঠার মতো পরিস্থিতি, কামাল আদওয়ান হাসপাতালের।
উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালের চাতালে গতকাল সকাল থেকে লোকজন ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে লাশ খুঁজছে। ভেসে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। বছর ৫০-এর মেহমুদ আসাফ তার পরিবারের দু’টি বাচ্চাকে একটি ঠেলা গাড়িতে উঠিয়ে জাবালিয়া শিবির থেকে এই হাসপাতালে এনেছিলেন চিকিৎসার জন্য। গত ১০ দিন এই হাসপাতালে ভর্তি ছিল শিশু দু’টি। এর মাঝে অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। মেহমুদ বলেন, ‘আজ হাসপাতালে এসে দেখি হাদির শরীরে কোনো সাড় নেই, প্যারালাইজড। চেয়ারের নিচে চিত হয়ে শুয়ে রয়েছে। ওর উপরে সব ভেঙে পড়েছে।’ শিশুটির জ্ঞান প্রায় নেই। শরীর পুড়ে গেছে। হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ১২ ডিসেম্বর থেকে কামাল আদওয়ান হাসপাতালটি ইসরাইলি সেনার দখলে ছিল। শনিবার বাহিনী হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে যায়। জানিয়ে যায়, এখানে তাদের ‘কাজ’ শেষ হয়ে গেছে।
উত্তর গাজায় এই একটি মাত্র হাসপাতাল কাজ করছিল। ইসরাইলি বাহিনী জানিয়েছে, ওই হাসপাতাল থেকে তারা ৮০ জন হামাস সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বাহিনী আরো দাবি করেছে, হাসপাতালের কর্মীরা জেরার মুখে স্বীকার করেছেন, সদ্যোজাত শিশুদের রাখার জন্য ব্যবহৃত ইনকিউবেটরের ভেতরে অস্ত্র লুকোনো ছিল।
মেহমুদ জানান, বাহিনী সরতেই তিনি বাচ্চাদের হাসপাতাল থেকে নিতে এসেছিলেন। এত দিন ঢুকতে পারছিলেন না। কিন্তু হাসপাতালে এসে শিউরে ওঠেন। বলেন, ‘কোনো কিছু অক্ষত নেই। চার দিকে শুধু রোগী। বাচ্চাদের শরীর ভয়ানকভাবে পুড়ে গেছে। এত দিন ওদের কিছু খেতে দেয়া হয়নি। পানি দেয়া হয়নি। চিকিৎসা তো হয়ইনি।’
হামাসের দাবি, হাসপাতালগুলোতে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। রোগীদের ঘরে ঢুকে গুলি চালাচ্ছে, বুলডোজার দিয়ে হাসপাতালের চাতালের অস্থায়ী শিবিরগুলো ভেঙে দিচ্ছে। ছেলেকে খুঁজতে কামাল আদওয়ান হাসপাতালে এসে চাতালে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন আবু মোহম্মদ।। তিনি বলেন, ‘তারা গোটা বাড়িটাই ধ্বংস করে দিয়েছে। ডাক্তারদেরও মেরে ফেলেছে। তাদেরকেও রেহাই দেয়নি। কিছু নেই আর এখানে। ছেলে এখানে ভর্তি ছিল। জানি না, কিভাবে ওকে খুঁজে বের করব।’
আবুর সন্দেহ, ধ্বংসস্তূপের নিচে কোথাও চাপা পড়ে রয়েছে তার ছেলে। তার কথায়, ‘আর পারছি না। সেই ১৯৪৮ সাল (ইসরাইল প্রতিষ্ঠা হয় সে বছর) থেকে ওরা আমাদের হত্যা করে চলেছে... ওরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলুক। তা হলে এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পাব আমরা।’
গতকাল নিউ ইয়র্কের একটি মানবাধিকার সংগঠন অভিযোগ করেছে, ইসরাইল সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ তৈরি করছে। নিরীহ মানুষকে অভুক্ত রাখা হচ্ছে। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা