দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ৩৭ দিন। ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমার প্রক্রিয়া শেষ হচ্ছে আজ। এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি ও তাদের মিত্র কয়েকটি দল। তবে ইতোমধ্যেই নির্বাচনী মাঠে তৎপর হয়েছে নিবন্ধিত ২৬টি দল। এসব দলের মনোনীতদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীও ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচন একতরফা হওয়ার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও চাইছেন একটি ‘সুন্দর’ নির্বাচন। সেই লক্ষ্যে ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতার বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ ১৮টি নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য ও সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিতর্ক মুছে দিতে ভোটার উপস্থিতির মাধ্যমে একটি জমজমাট নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করছে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তাদের নিরপেক্ষ ইমেজ তৈরির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকেও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের দৃঢ় প্রত্যয় দেখা যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন।
সূত্র জানায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুন্দর ও উৎসবমুখর করতে দলীয় প্রার্থী পছন্দের ক্ষেত্রে মুনশিয়ানা .দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি অংশ না নিলেও জাতীয় নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট করতে এবার নানা কৌশল অবলম্বন করছে ক্ষমতাসীনরা। এ জন্য দলের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রতিটি আসনে ডামি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন। এ ছাড়া নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার নির্দেশও দেন। কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালে তাকে কোনোভাবেই বাধা দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ জিতে এলে সেসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন। এতে করে প্রতিটি আসনে মনোনয়নবঞ্চিত মন্ত্রী এমপি থেকে সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার হিড়িক পড়েছে, যা নির্বাচনের সেই প্রচলিত পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোরেশোরে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির হরতাল অবরোধের টানা কর্মসূচির বিপরীতে দেশে একটা নির্বাচনী আমেজ তৈরি করার জন্য নানান কৌশল অবলম্বন করছে দলটি। নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যস্ততায় সারা দেশে নির্বাচনী আমেজ ফিরে এসেছে। তবে সারা দেশে প্রতিটি আসনে দলের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে জিতে আসতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, দল ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায়, কার জনপ্রিয়তার কি অবস্থা, তা একটু যাচাই করা ও পরীক্ষা নেওয়া দরকার।
৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন ৩ হাজার ৩৬২ জন। মনোনয়ন বোর্ডের সভায় যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যেম প্রার্থী চূড়ান্ত করে ২৬ নভেম্বর ২৯৮ জনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিতর্কিত ও অজনপ্রিয়দের ছাঁটাই করেছেন। এ কারণেই ৭১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যরা মনোনয়ন পাননি। একই সঙ্গে মনোনয়নবঞ্চিত এমপি-মন্ত্রী কেউ যেন বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন না করতে পারে এ জন্য দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নমনীয় মনোভাব ব্যক্ত করে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, জমজমাট ও উৎসবমুখর করারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ অবস্থান ও কালিমামুক্ত একটি নির্বাচন উপহার দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবিচল লক্ষ্যে বাস্তবায়ন করতে আইনশৃঙ্খলা, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনও কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের ইঙ্গিত দিয়েছে, যা ভোটারদের মাঝে আস্থা অর্জনে দারুণ টোটকা হিসেবে কাজ করবে বলে জানিয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, দলের ভেতরে ও বাইরে নানামুখী তৎপরতা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ‘সুন্দর’ নির্বাচন চাইছেন। যারাই অংশগ্রহণ করুক না কেন, কেউ যেন নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে, সেটাই তার লক্ষ্য। এ কারণে অন্য কোনো দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যাতে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হন—তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘দেশে একটি সুন্দর নির্বাচন হবে এটা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি। উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটাররা যাতে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে সেজন্য আওয়ামী লীগ সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে। ইতোমধ্যে প্রার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে, যা একটি উৎসবমুখর পরিবেশে সুন্দর নির্বাচনের সাক্ষ্য দিচ্ছে।’
জানা গেছে, টানা তিনবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা আধিপত্য বিস্তার করতে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছেন। নিজস্ব বলয় তৈরি করতে গিয়ে অন্য দল থেকে বিতর্কিত ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছেন। এ কারণে অনেক এলাকায় বর্তমান এমপি, মন্ত্রী কিংবা নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা এখন স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। তৃণমূলের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, যিনি যে জনপ্রিয় তিনিই নির্বাচিত হয়ে আসুক।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পরিবেশ ভালো। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে তৈরি হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, শেষ পর্যন্ত এটা বজায় থাকবে।’