নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, আগামী বছর থেকে ৯ম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা বিভাগ বিভাজন থাকবে না। সব শিক্ষার্থীকেই মাধ্যমিক পর্যন্ত অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানার আগ্রহ, তাহলে কবে, কীভাবে হবে এই বিভাগ বিভাজন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীই ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়বে। তারপর উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ বিভাজন হবে। তাঁদের প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো, উচ্চমাধ্যমিকে তিনটি বিষয় সবার জন্যই বাধ্যতামূলক থাকবে। আর নির্বাচিত বিষয়গুচ্ছ (যেমন পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, অর্থনীতি ইত্যাদি) থেকে একজন শিক্ষার্থী তার আগ্রহ অনুযায়ী যেকোনো তিনটি বিষয় নির্বাচন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নমনীয়তার সুযোগ রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থী চাইলে বিজ্ঞান বিষয়ের পাশাপাশি অন্য বিভাগের বিষয়ও নেওয়ার সুযোগ পাবে। যেমন একজন শিক্ষার্থী চাইলে পদার্থ, রসায়নের পাশাপাশি অর্থনীতিও নেওয়ার সুযোগ পাবে। একইভাবে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরাও মিশ্র বিষয় নেওয়ার সুযোগ পাবে। বর্তমানে একেকটি বিভাগের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত বিষয় নিতে হয়। এ ছাড়া নতুন পদ্ধতিতে পেশাদারির দক্ষতার জন্য আরেকটি বিষয় ঐচ্ছিকভাবে নেওয়ার সুযোগ থাকবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের বিষয় নির্বাচনের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আগামী বছরের মে-জুনের দিকে চূড়ান্ত করা হবে। তবে তাঁদের প্রাথমিক পরিকল্পনায় উল্লেখিত বিষয়গুলো আছে। আরও আলাপ-আলোচনা করে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
গত জানুয়ারি থেকে ১ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হয়েছে। আগামী বছর ২য়, ৩য়, ৮ম ও ৯ম শ্রেণিতে তা শুরু হবে। এরপর ২০২৫ সালে ৪র্থ, ৫ম ও ১০ম শ্রেণিতে চালু হবে। উচ্চমাধ্যমিকে একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।
এনসিটিবি জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকেই অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। বিষয়গুলো হলো—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান (বিজ্ঞান অনুশীলন বই ও বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ নামে দুটি বই), ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং ধর্ম (চার ধর্মের জন্য পৃথক চারটি বই)।
এনসিটিবি জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকেই অভিন্ন ১০টি বিষয় পড়তে হবে। তবে শ্রেণি অনুযায়ী বিষয়গুলোর আধেয়তে তারতম্য থাকবে। ভলিয়মও কমবেশি হবে। বিষয়গুলো হলো—বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান (বিজ্ঞান অনুশীলন বই ও বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ নামে দুটি বই), ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং ধর্ম (চার ধর্মের জন্য পৃথক চারটি বই)।
কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিষয়ে ভিন্নতা চলে আসবে। তখন বাংলা, ইংরেজি ও সমন্বিত আরেকটি বিষয় সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে। বাকি চারটি (তিনটি নৈর্বাচনিক ও একটি ঐচ্ছিক) শিক্ষার্থীরা পছন্দ অনুযায়ী বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো নম্বরের ব্যবস্থা নেই। ওয়েটেজ বা ভর দিয়ে বিবেচনা করা হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি ও সমন্বিত বিষয়ে ভর মাধ্যমিক স্তরের চেয়ে কম থাকবে। বেশি গুরুত্ব পাবে নিজ নিজ বিভাগের বা বিশেষায়িত বিষয়গুলো। এর মধ্যে বিশেষায়িত বিষয়গুলোর জন্য মোট ভরের তিন–চতুর্থাংশ এবং এক–চতুর্থাংশ আবশ্যিক বিষয়ের জন্য বরাদ্দ থাকবে। সেভাবে বিষয় বিন্যাস ও পরিসর সাজানো হবে।
উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পরিকল্পনায় আছে। তবে যেভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতে সবার জন্যই ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি।
অভিভাবকদের একাংশের দাবি, নতুন এ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু তা মানতে নারাজ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। তাঁর যুক্তি নতুন এই ব্যবস্থার ফলে দেশে বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়বে। বর্তমানে মাধ্যমিকে মাত্র ১৯ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে এই হার আরও কমে যায়। নতুন শিক্ষাক্রমে ১০ম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বিষয়গুলোও পড়ার সুযোগ পাবে। এর মানে হলো, শতভাগ শিক্ষার্থীর মধ্যেই বিজ্ঞানের প্রসারতা বাড়বে।
আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে, এখন ৯ম-১০ম শ্রেণিতে যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে, তাদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ভলিয়ম বেশি, যা তার উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞানে পড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় সেটি হোঁচট খাবে কি না?
যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনায় নিয়ে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।
যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনায় নিয়ে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।ফাইল ছবি
এ বিষয়ে অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের উত্তর সেটি হবে না। কারণ, ৯ম-১০ম শ্রেণিতেও শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়বে। এরপর তার সঙ্গে মিল রেখে উচ্চমাধ্যমিকে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে সমস্যা না হয়। উচ্চমাধ্যমিকে বিশেষায়িত বিষয়ের ভলিয়ম বেশি থাকবে। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।
# উচ্চমাধ্যমিকে তিনটি বিষয় সবার জন্য বাধ্যতামূলক
# বিভিন্ন বিষয়গুচ্ছ থেকে তিনটি বিষয় নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা
# একটি বিষয় ঐচ্ছিকভাবে নেওয়ার সুযোগ থাকবে
# একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বোর্ডের অধীন আলাদা পরীক্ষা হবে
নতুন পদ্ধতিতে শুধু ১০ম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা হবে। নতুন ব্যবস্থায় ২০২৬ সালে হবে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। এখন ৯ম ও ১০ম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হয় এসএসসি পরীক্ষা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মূল্যায়ন হবে। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীন পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হয় এইচএসসি পরীক্ষা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পরিকল্পনায় আছে, তবে যেভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতে সবার জন্যই ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি। সূত্র: প্রথম আলো।