ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছেন তরুণী। এক পায়ে প্লাস্টার। তাঁকে সাহায্য করছেন এক সশস্ত্র হামাস যোদ্ধা। গায়ে সামরিক পোশাক, মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। তিনি সযত্নে তরুণীকে তুলে দিলেন অ্যাম্বুল্যান্সে। তরুণীর মুখে কান্না মেশা হাসি। যাওয়ার আগে হামাস-যোদ্ধা হাত নেড়ে বিদায় জানালেন তরুণীকে। তিনিও হাত নাড়লেন। দু’জনেই হয়তো ‘ভাল থাকার’ বার্তা দিলেন একে অপরকে...। কোথাও কোনও ঘৃণার চিহ্ন নেই। এমন একটা নয়, সংবাদমাধ্যম মারফত একাধিক ভিডিয়ো ছড়িয়েছে ইন্টারনেটে। তবে ক্যামেরার পিছনে এটা কতটা সত্যি, তা জানা নেই। সকলেই জানেন, এই যুদ্ধ-বিরতি, মুক্তির মুহূর্ত ক্ষণস্থায়ী। আজও বন্দি-বিনিময় করেছে হামাস ও ইজ়রায়েল। ১৩ জন ইজ়রায়েলি, ৩ জন তাই-নাগরিক ও এক জন রুশকে ছেড়েছে তারা। কালও হয়তো বন্দি-বিনিময় হবে। তার পর ফের শুরু হবে যুদ্ধ।
গত কাল রাতের দিকে বেশ চাপানউতোর তৈরি হয়েছিল। হামাসের অভিযোগ, চুক্তিমাফিক গাজ়ায় যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছে না ইজ়রায়েল। ত্রাণ না পাঠালে বন্দিদের ছাড়া হবে না। পাল্টা হুমকি দেয় ইজ়রায়েল। তারা জানায়, বন্দিদের ছাড়া না হলে রাতেই ফের যুদ্ধ শুরু করা হবে। শেষে কাল বেশ রাতে ১৭ জন বন্দিকে মুক্তি দেয় হামাস। এর মধ্যে ১৩ জন ইজ়রায়েলি ও ৪ জন তাইল্যান্ডের নাগরিক। ইজ়রায়েলিদের মধ্যে ৬ জন মহিলা ও ৭টি শিশু-কিশোর-কিশোরী। রেড ক্রসের গাড়িতে সকলে রাফা সীমান্তে পৌঁছন। সেখান থেকে রাতেই ইজ়রায়েলের হাতজ়েরিম বায়ুসেনা ঘাঁটিতে পৌঁছন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দফতর থেকে ১৩ জন বন্দির মুক্তির ভিডিয়ো প্রকাশ করা হয়েছে। এই দলে ৯ বছরের একটি আইরিশ-ইজ়রায়েলি বালিকাও রয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার বাবা জানতেন মেয়ে মারা গিয়েছে। বাবা-মেয়ের পুনর্মিলনের দৃশ্য ভিডিয়ো করতে ভোলেনি ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। তাতে দেখা গিয়েছে, গোলাপী সোয়েটার গায়ে একটি বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে উঠেছে।
ইজ়রায়েলও কাল গভীর রাতে ৩৯ জন প্যালেস্টাইনিকে মুক্তি দিয়েছে। রেড ক্রসের গাড়িতে তাঁরা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের আল বিরেতে পৌঁছন। অসংখ্য মানুষ তাঁদের অভিবাদন জানান। তাঁদের অনেকের হাতেই হামাসের পতাকা ছিল। মুখে হামাসপন্থী স্লোগান। নুরহান আওয়াদ নামে এক তরুণীকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে এক ইজ়রায়েলি সেনাকে কোপানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। ইসরা জাবিস নামে অন্য এক তরুণী ২০১৫ সালে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটান। তাতে এক সেনা জখম হয়েছিলেন। ইসরা নিজেও পুড়ে গিয়েছিলেন। তিনিও আজ মুক্তি পেয়েছেন জেল থেকে।
গাজ়ায় যুদ্ধ-বিরতি চললেও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক শান্ত নেই। রোজই ভাঙচুর চলছে। আজও পাঁচ জন প্যালেস্টাইনি খুন হয়েছেন ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জেনিন এলাকায়। ১৮ জন জখম। এর মধ্যে দু’জনের অবস্থা সঙ্কটজনক। আজ প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে জেনিনে ভাঙচুর চালিয়েছে পুলিশ। ইয়ুতমা গ্রামেও সামরিক অভিযানে তিন জন প্যালেস্টাইনি খুন হয়েছেন। গাজ়ার মতো ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের হাসপাতালগুলিতেও হানা দিচ্ছে ইজ়রায়েলি সেনা। আজ জেনিনের মূল হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে পড়ে সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক। অ্যাম্বুল্যান্সগুলিতে তল্লাশি চালায় সেনারা। সেখানেও দু’জনকে আটক করা হয়েছে।
গাজ়ায় আজও বহু মানুষ প্রিয়জনের সন্ধানে ‘বাড়ি’ ফিরেছেন। বাড়ি বলে অবশ্য কিছু আর বেঁচে নেই। ইট-কাঠ-পাথরের স্তূপ। কংক্রিটের স্ল্যাবের তলা থেকে আজও টেনে বার করা হয়েছে বহু দেহ। যুদ্ধ-বিরতির মধ্যে যদি সম্মানজনক ভাবে শেষকৃত্য করা যায়, সেই চেষ্টা করছেন অনেকে। যুদ্ধ বন্ধ থাকায় গাজ়ার কেন্দ্রস্থলে ঢুকতে পেরেছেন সাংবাদিকরাও। চারদিকে শুধুই ধ্বংসের ছবি। যেন কোনও দানব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে শহরকে শহর। আজ প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে এ পর্যন্ত গাজ়া ভূখণ্ডে ৪০ হাজার টন বিস্ফোরক ব্যবহার করেছে ইজ়রায়েল। তাঁদের দাবি, ইজ়রায়েলের এটাই লক্ষ্য ছিল, যাতে গাজ়া আর বাসযোগ্য না থাকে। হামাসের এক নেতা বলেন, শুধু ইজ়রায়েল নয়, এই ‘গণহত্যা’য় শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছে আমেরিকা। তিনি বলেন, ‘‘ওরা সবসময় ইজ়রায়েলকে সমর্থন করে। যুদ্ধের গোড়া আমেরিকা এই অপরাধের অংশীদার। একটা জাতিকে শেষ করতে উঠেপড়ে লেগেছে ওরা।’’