উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বোরো ধানের আবাদ বাড়াতে দেশের ৬৪ জেলার ১৫ লাখ কৃষককে বিনা মূল্যে সার ও বীজ দিচ্ছে সরকার। কৃষি প্রণোদনার আওতায় এ খাতে সরকারের বরাদ্দ ১০৭ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই টাকায় মোট ৭৫ হাজার মেট্রিক টন বীজধান এবং ৩০ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক এমওপি ও ডিএপি সার দেওয়া হবে। এতে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়তি ফসল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য এ খাতে অর্থ ছাড় করে আগাম উত্তোলনের মঞ্জুরি আদেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নাঈমা আফরোজ ইমা স্বাক্ষরিত সরকারি নির্দেশনায় জেলা পর্যায়ের কৃষি পুনর্বাসন কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণোদনা বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ৬১ জন জেলা প্রশাসক ও পার্বত্য তিন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা এই কমিটির সভাপতি।
প্রণোদনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখাই সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বোরো ধানের উফশী জাতের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন উদ্ভাবিত উফশী জাতের আবাদের ক্ষেত্র বাড়বে। বাড়বে কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার ও আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ। এতে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে এবার প্রায় ৫৬ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় এক কোটি ৬৪ লাখ মেট্রিক টন চাল। নতুন উন্নতজাতের উফশী বীজের সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ায় হেক্টরে ৪.৮ মেট্রিক টন হিসাবে ৮.১৬ মেট্রিক টন অতিরিক্ত চাল উৎপাদন হবে। বরাদ্দ করা সারের অর্থমূল্য ৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও উফশী ধানের বীজ ৪২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর বাইরে পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৩ লাখ সাত হাজার ৫০০ টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, ৪০ টাকা কেজি দরে বাড়তি ফসলের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় তিন হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাড়তি ৯ লাখ ৭৯ হাজার ২০০ মেট্রিক টন খড়ও উৎপন্ন হবে। তিন টাকা কেজি হিসাবে এর মূল্য ২৯৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বাড়তি খড়ে গোখাদ্যের নিশ্চয়তা বাড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) বাদল চন্দ্র বিশ্বাস কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় ফসলের উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি উফশী নতুন জাতের ধানের বীজের ফলন বাড়াতে বোরোয় প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু জেলায় প্রণোদনার সার ও বীজ বিতরণ শুরু হয়েছে।
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এ বছর বোরো চাষাবাদে নতুন আটটি দেশি উফশী জাতের ধানের আবাদ বাড়ানো হবে। এগুলো এখনো অতটা প্রচলিত হয়নি। জাতগুলো হচ্ছে ব্রিধান-৬৭, ব্রিধান-৭৪, ব্রিধান-৮৯, ব্রিধান-৯২, ব্রিধান-১০০, বিনাধান-১০, বিনাধান-২৪ ও বিনাধান-২৫। এসব বীজ সরবরাহ করবে বিএডিসি ও ডিএই প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রত্যেক উপকারভোগী কৃষককে ১০ কেজি করে মোট ২০ কেজি ডিএপি ও এমওপি সার এবং পাঁচ কেজি করে উফশী বীজ দেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের সাত জেলাসহ প্রণোদনার সবচেয়ে বেশি সার ও বীজ বরাদ্দ পাওয়া জেলা ১৭টি। অপর জেলাগুলো হচ্ছে ময়মনসিংহ, টাংগাইল, জামালপুর, কুমিল্লা, নওগাঁ, বগুড়া, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জ। ১৭টি জেলায় মোট সাত লাখ ২১ হাজার উপকারভোগী কৃষক পাচ্ছেন পাঁচ কোটি ১৮ লাখ ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা মূল্যের ১৪ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন সার ও তিন হাজার ৬০৫ মেট্রিক টন বীজ। সবচেয়ে কম বরাদ্দ পাওয়া জেলা নারায়ণগঞ্জ ও রাঙামাটি। জেলা দুটিতে তিন লাখ ৫৮ হাজার ৭৫০ টাকা করে পাচ্ছেন উপকারভোগীরা। দুই পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে বরাদ্দ চার লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় উপকারভোগী কৃষকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৫৫ হাজার জন করে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক ৫০ হাজার করে কৃষক রয়েছেন সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায়। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৬ হাজার, হবিগঞ্জে ৩৫ হাজার, সিলেটে ৩০ হাজার ও মৌলভীবাজার জেলার ২২ হাজার উপকারভোগী কৃষক রয়েছেন।
হাওরাঞ্চলের ৭ জেলায় দুই কোটি টাকার সার ও বীজ
হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় উপকারভোগী কৃষক রয়েছেন দুই লাখ ৭৮ হাজার জন। এসব জেলার কৃষকরা পাচ্ছেন মোট দুই কোটি ৫০০ টাকার সার ও বীজ। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন সার ও এক হাজার ৩৯০ টন বীজ।
সূত্র মতে, কিশোরগঞ্জ জেলায় এক হাজার ১০০ টন সার ও ২৭৫ টন বীজ বিতরণ করা হবে। যার অর্থমূল্য ৩৯ লাখ ৪৬ হাজার ২৫০ টাকা। আরো দুই জেলা ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলেও সমপরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা জেলাভিত্তিক সর্বোচ্চ।
হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ৩৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের এক হাজার টন করে সার ও ২৫০ টন করে বীজ বরাদ্দ হয়েছে। সিলেটে ২১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের ৬০০ টন সার ও ১৫০ টন বীজ, মৌলভীবাজারে ১৫ লাখ ৭৮ হাজার ৫০০ টাকার ৪৪০ টন সার ও ১১০ টন বীজ, হবিগঞ্জে ২৫ লাখ ১১ হাজার ২৫০ টাকার ৭০০ টন সার ও ১৭৫ টন বীজ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২৫ লাখ ৮৩ হাজার টাকার ৭২০ টন সার ও ১৮০ টন বীজ বরাদ্দ হয়েছে।
হাওরাঞ্চলের কৃষকরা জানান, কার্তিকের শেষ সপ্তাহে বীজতলা তৈরি শুরু হয়েছে। হাওরে কিছুটা আগেই বীজতলার কাজ শুরু করেন কৃষকরা। উজান এলাকায় রোপা আমন কাটার পর কিছুটা দেরিতে বীজতলা তৈরি হয়। কৃষকরা মনে করছেন, খুব দ্রুত সার ও বীজ বিতরণের কাজ শেষ করা দরকার। অন্যথায় আবাদ পেছাতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রণোদনার সার ও বীজ এখনো বিতরণ শুরু হয়নি। তাঁদের ভাষ্য, এবার এসংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা এসেছে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। এ জাতীয় নির্দেশনা সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে এলে কৃষকরা সময়মতো প্রণোদনার সার-বীজ পাবেন।
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা মিঠামইনের কায়স্থহাটির কৃষক জাকারিয়া খান জানান, তিনি পাঁচ-ছয় একর জমির জন্য বীজতলা তৈরি করে ফেলেছেন। বীজতলার একাংশে বাজার থেকে বীজ কিনে বপনও করেছেন। আরো কিছুদিন আগে সরকারি প্রণোদনার বীজ ও সার পেলে তাঁর মতো বহু কৃষক লাভবান হতেন বলে তিনি মনে করেন।
বোরোয় প্রণোদনার সার ও বীজ বিতরণের বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, দুই-চার দিনের মধ্যে জেলায় বিতরণ শুরু হবে। কৃষকদের তালিকার জন্য তাঁদের এনআইডি সংগ্রহের কাজ চলছে। তিনি জানান, এবার বিতরণের বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এতে কোথাও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে, আবার কোথাও উপজেলা সদর থেকে সার ও বীজ বিতরণ করা হবে। এর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে।
সমলয় চাষাবাদে বরাদ্দ সাড়ে ১৭ কোটি টাকা
বোরোয় প্রণোদনার বাইরেও দেশের কৃষকদের মধ্যে সমবায়ী মনোভাব গড়ে তোলার চেষ্টা করছে সরকার। সেই লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নতুন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বোরোর হাইব্রিড ধানের সমলয় চাষাবাদ ব্লক প্রদর্শনী স্থাপনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ১৭ কোটি ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ৩১ অক্টোবর কৃষি মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি অনুমোদন করেছে।
বরাদ্দ টাকায় ৫০ একরের একেকটি ব্লক স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্র মতে, সারা দেশে এ রকম ১২২টি ব্লক স্থাপন করা হচ্ছে। প্রতিটি ব্লকের খরচ ধরা হয়েছে ১৪.২৮৫ লাখ টাকা করে।