একদা অবহেলিত ক্ষুদ্রদ্বীপ মাতারবাড়ি এখন স্বপ্ন দেখাচ্ছে দেশের অর্থনীতি বদলে দেওয়ার। সেখানে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর। ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দর চালুর টার্গেট থাকলেও এরই মধ্যে ভিড়ে গেছে বড় জাহাজ। একের পর এক মাদার ভেসেলে আসছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা। বন্দর অবকাঠামো তৈরির আগে প্রস্তুত হয়ে গেছে এর চ্যানেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এ চ্যানেল উদ্বোধন করবেন আগামী কাল শনিবার। একইসঙ্গে স্থাপন করবেন বন্দর অবকাঠামো নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর। তাঁর আগমন ঘিরে সেজেছে কক্সবাজারের বদলে যাওয়া দ্বীপ মাতারবাড়ি। নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বৃহস্পতিবার মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়া পরিদর্শনে যান।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য সামাল দিতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের খুবই প্রয়োজন, যা উপলব্ধি করতে পেরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। এ জন্য মহেশখালীকেই বেছে নেওয়া হয় সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে। প্রথমে বিবেচনায় ছিল সোনাদিয়া। কিন্তু মাতারবাড়িতে জাপানের সহায়তায় একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য চ্যানেল প্রস্তুত করতেই দেখা দেয় সম্ভাবনার উঁকি। অর্থাৎ সেই চ্যানেল আরেকটি দীর্ঘায়িত করলেই হয়ে যায় গভীর সমুদ্রবন্দর। এতে করে ব্যয় সাশ্রয় হবে অনেক। ফলশ্রুতিতে সোনাদিয়া থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর চলে আসে মাতারবাড়িতে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ তদারকি এবং অর্থায়নে হতে যাচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। ২০২৬ সালের মধ্যে জাহাজ ভেড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এগোতে থাকে গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ। কিন্তু জাহাজ ভেড়ানোর জন্য এত সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল মাতারবাড়ির জেটিতে কয়লা নিয়ে ভেড়ে প্রথম জাহাজ। জাহাজটি আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। এর পর কয়লাবোঝাই জাহাজ ভিড়ছে নিয়মিত। বন্দর অবকাঠামো গড়ে না উঠলেও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেছে চ্যানেল। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যেটুকু চ্যানেল এর মধ্যে হয়ে গেছে তা গভীর সমুদ্রবন্দরেরই অংশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাল শনিবার যাচ্ছেন কক্সবাজারে। সেখানে তিনি উদ্বোধন করবেন দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ এবং বন্দর চ্যানেলসহ বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের। কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম হতে যাচ্ছে বন্দর, বিদ্যুৎ ও শিল্প হাব। সে জন্যই ইতোমধ্যেই চালু হয়ে গেছে কর্ণফুলীর তলদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এ টানেলের ভেতর দিয়ে যাবে মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ। মীরসরাইয়ে সাগরের তীরঘেঁষে সুপার ডাইক নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। বন্দরনগরীর ওপারে আনোয়ারায় হবে শিল্পজোন। টানেলকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় শিল্প স্থাপনের জন্য জমি ক্রয়সহ ব্যবসায়ীদের তোড়জোড় শুরু হয়েছে কয়েক বছর আগে থেকেই।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন ও প্রথম টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হতে যাচ্ছে কাল শনিবার। আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে মুখিয়ে আছে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী।
এদিকে, বুধবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও বন্দর সচিব ওমর ফারুকসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, মাতারবাড়ি হবে দেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত। এই বন্দর শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোও উপকৃত হবে। চ্যানেল প্রস্তুত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টার্মিনাল নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। এই বন্দর হয়ে গেলে জাতীয় অর্থনীতিতে দুই বিলিয়ন ডলার যুক্ত করবে।
প্রতিবেশী দেশগুলোকে বন্দর সুবিধা প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই বলেন, আমরা সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। এই বন্দর তারই একটি সিম্বল।
মাতারবাড়ির উন্নয়ন বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, টার্মিনাল, সড়ক, রেল সংযোগ- সবকাজ একসঙ্গেই এগিয়ে যাবে। বর্তমান মন্দা অবস্থার মধ্যে অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রধামন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বে রয়েছে। কোভিড, যুদ্ধ আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি। টাকার কোনো সমস্যা হবে না। এখন থেকে আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের একটি গভীর সমুদ্রবন্দর আছে।
চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল সোহায়েল বলেন, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের এক মাসের মধ্যে প্রথম টার্মিনালের কাজ শুরু হয়ে যাবে। আড়াই থেকে তিনবছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে। একটি টার্মিনালে চারটি জাহাজ ভিড়তে পারবে। বিদ্যমান বন্দরের চেয়ে তিনগুণ বেশি পণ্য বহন করতে পারবে গভীর সমুদ্রবন্দরে ভেড়া জাহাজগুলো। এতে পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় অনেক কমে যাবে।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরকালে ওই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক ইচ্ছায় ঘোষিত হয় ‘বিগ বি’ অর্থাৎ বে-অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট। এর আওতায় মাতারবাড়ীতে প্রথমে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কোল পাওয়ার জেনারেশন বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রকল্পের জন্য ২৫০ মিটার প্রস্থের ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল তৈরি করা হয়। আর এতেই দেখা দেয় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা।
ঘোষিত বে-অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বিগ-বি) এর আওতায় গভীর সমুদ্র বন্দর ও মহেশখালিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেবে। একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে রেল, সড়ক ও নৌ নেটওয়ার্ক। গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানিতে অন্যদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট নির্ভরতা কমাবে। বাংলাদেশ নিজেই হতে যাচ্ছে একটি ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের মালিক। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন হয়ে গেছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে রেল লাইন যুক্ত হবে।
বাস্তবায়নকারি সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, আড়াইশ মিটার প্রস্থের সঙ্গে আর ১০০ মিটার বাড়িয়ে গভীর সমুদ্র বন্দর করা হবে। অর্থাৎ ৩৫০ মিটার প্রস্থের একটি চ্যানেল এই সমুদ্র বন্দরের প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। মহেশখালীর মাতারবাড়ীর এ বন্দরে ভিড়তে পারবে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ।
জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় সেখানে ১৪১৪ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২০১৮ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এই কোল জেটির চ্যানেলের গভীরতা বৃদ্ধি ও প্রস্থ সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে হয়ে যাচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর। এরমধ্যেই বেশকটি মাদার ভেসেলসহ জেটিতে ভিড়েছে বহু জাহাজ।
মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এ পোর্ট হবে এই এলাকার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর। বাংলাদেশের অন্যান্য বন্দরকে সেবাদানের পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশও তাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে পারবে। এ বন্দরের সঙ্গে থাকবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। জল, স্থল এবং রেলপথে সংযুক্ত থাকবে মাতারবাড়ী।