যথাসময়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চলছে সম্ভাব্য সব রকম প্রস্তুতি। নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয়, প্রশিক্ষণ, অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতসহ নির্বাচন পরিচালনা ব্যয় হিসেবে বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ৮০ শতাংশ নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয় করা হয়ে গেছে। আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, সিনিয়র ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে চলছে ইসির মতবিনিময়; মাঠ কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যেই ইসির তরফে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। এরই মধ্যে এগিয়ে চলছে নির্বাচনী প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণও। যদিও বড় দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরের বিপরীত মেরুতে অবস্থানের কারণে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে একটা দোলাচল চলছে; সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কার মেঘও।
রাজনৈতিক বাহাস, কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপের মধ্যেই যথাসময়ে ভোটগ্রহণের পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ প্রসঙ্গে বলেনÑ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করতে আমাদের প্রয়াসে কোনো ঘাটতি থাকবে না। অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে বলেও জানান তিনি।
সিইসি বলেন, সরকারের জনপ্রশাসন, পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সঙ্গে সমন্বয় কীভাবে সুদৃঢ় এবং সহজ হবে সেটা বের করে নির্বাচনের যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনের ফলাফল উঠে আসবে; আমরা সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রথমবার সব আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, সিনিয়র ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে কমিশন। গতকাল শনিবার নির্বাচন ভবনে ৬৪ জেলা ও ১০টি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে সংসদ নির্বাচন নিয়ে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে কমিশনের পক্ষ থেকে মাঠ কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয় বলে জানা গেছে। মতবিনিময়কালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, আপনাদের অভিজ্ঞতা শুনতে চাইব। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি কতটা সম্পন্ন হয়েছে এবং কতটা ঘাটতি রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করব। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রশাসনিক সহায়তার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন মাঠপর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তারা। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি তারা অনুরোধ করেছেন। তারা কার্যত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতার কথা বলেছেন।
মতবিনিময় শেষে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, মেইনলি তারা (মাঠ কর্মকর্তারা) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতার কথা বলেছেন। জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) সকলের সহযোগিতা নিয়ে তাদের কাজ করতে হবে। আমাদের সামনে প্রশিক্ষণ আছে ডিসি, এসপিদের সঙ্গে। সে সময় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে। তারা যে সমস্যার কথা বলেছেন, সেটা প্রশাসনিক। কোনো রাজনৈতিক সমস্যার কথা তারা বলেননি।
তিনি বলেন, এটা মূলত প্রাথমিক সভা। কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে, কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মূলত ভোটার তালিকা, ভোটকেন্দ্রের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। তাদের সুনির্দিষ্ট সমস্যা আছে কিনা, একেক অঞ্চলে একেক সমস্যা থাকতে পারে। সেটা জানতে চাওয়া হয়েছে। যেমন পার্বত্য অঞ্চলে কিছু কেন্দ্র আছে এরকম সব
জায়গায় কিছু কিছু নির্দিষ্ট সমস্যা রয়েছে, তা অবহিত হয়েছে কমিশন।
অতিরিক্ত সচিব আরও বলেন, কোথাও কোনো ত্রুটি থাকলে ইসিকে জানানোর জন্য বলা হয়েছে। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলাসহ সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছেন। তারা অতিরিক্ত কিছু চাননি। কোনো ঘাটতির কথা উল্লেখ করেননি। নির্বাচনী আচরণ বিধি যাতে সবাই মেনে চলেন এজন্য তারা সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন। এই বিষয়েই বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার বিষয়ে আলোচনা হয়নি। তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ বা সংকটের কথাও তারা বলেনি। ভোটের জন্য মাঠের পরিবেশ এখনো ভালো আছে বলেই জানিয়েছেন অশোক কুমার।
এদিকে আগামী তিন মাসের মধ্যে অনুষ্ঠেয় এই ভোট আয়োজনের জন্য প্রায় ৮০ শতাংশ নির্বাচনী সামগ্রী ক্রয় ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনী কেনাকাটাসহ রোডম্যাপের অগ্রগতির বিষয়টি কমিশনকে অবহিত করা হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩ ধরনের নির্বাচনী উপকরণ কিনতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যালট বাক্স, ব্যালট বাক্সের ঢাকনা ও লক, অমোচনীয় কালি, বিভিন্ন ধরনের সিল, স্ট্যাম্প, সিল, বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ, কাগজ, প্যাড, রশি প্রভৃতি।
অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, সব কেনাকাটা চলছে। অনেক মালামাল পেয়েও গেছি। হুসিয়ান ব্যাগ, গালা, সিল, ব্যালট বাক্সসহ সবই পেয়েছি। আগের অর্ডারের মধ্যে কেবল অমোচনীয় কালি সাপ্লাই শেষ করতে পারেনি। কেনাকাটার ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশের বেশি অগ্রগতি হয়েছে।
ব্যালট পেপার প্রসঙ্গে ইসির এই কর্মকর্তা বলেন, ব্যালট পেপার আমরা বিজি প্রেস থেকে ছাপাব। একদম প্রতীক বরাদ্দের পর ছাপাতে দেওয়া হবে। ভোটের দশ-পনেরো দিন আগে ছাপানো হবে।
এদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের জন্য সব মিলিয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ রাখা হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায়, আর এক-তৃতীয়াংশ রাখা হয়েছে নির্বাচন পরিচালনার পেছনে। এ ছাড়া নির্বাচনে দশ লাখের মতো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োজিত করা হবে। দায়িত্ব পালন করবেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যরা। নির্বাচনী উপকরণ ক্রয় ও ভোটে দায়িত্বরতদের ভাতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ধরা হয় নির্বাচন পরিচালনা ব্যয়। আর বাকিটা ধরা হয় আইন-শৃঙ্খলা ব্যয়।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার হবে না। তাই সামগ্রিক অর্থে ব্যয় কম হবে। তবে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যার বেশির ভাগ যাচ্ছে বিভিন্ন বাহিনীর পেছনে।
এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেন, ইউনিট অনুযায়ী ব্যয়টা নির্ধারণ হয়েছে। যেমন পোলিং পারসনের সংখ্যা বেড়ে গেলে সেখানে মোট ব্যয়টা বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা আমাদের ব্যয় আছে আর কি।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ টাকা যাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে। মেজরিটি তাদের পেছনে যাবে। ৬৫ শতাংশ ব্যয় ওদের পেছনে যাবে। আর পরিচালনা ব্যয় হবে ৩৫ শতাংশ।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যয়টা ডেপ্লয়মেন্টের ওপরে বেড়ে যায়। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি এবং শেষে যদি আর্মি মোতায়েন করা হয়, সেভাবেই আমাদের ব্যয়টা ধরা হয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে এখনই বলা যাবে না, আরও ১০ দিন সময় লাগবে।
এদিকে ভোটের আয়োজন এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রশিক্ষণও শুরু করেছে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই)। সেপ্টেম্বরে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে ভোটের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ভোটের এক সপ্তাহ আগে ১০ লাখের মতো ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া মাঠ প্রশাসনকেও প্রশিক্ষণের আওতায় এনেছে ইটিআই। ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চলছে নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ।
প্রসঙ্গত, আগামী নভেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটের আয়োজন করতে চায় ইসি। চলতি একাদশ সংসদের প্রথম বৈঠক বসেছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। হিসাব অনুযায়ী, বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৯ জানুয়ারি। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ বহাল রেখে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে এর পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।