দুটি উৎসই বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়


আন্তর্জাতিক ডেস্ক : , আপডেট করা হয়েছে : 05-10-2023

দুটি উৎসই বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দেয়

নেপালে গত মঙ্গলবার কয়েক দফা ভূমিকম্প হয়েছে। এর আগের দিন ভারতের মেঘালয়েও একটি ভূকম্পন সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এবং আশপাশে তিন ধরনের ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে এই ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে। নেপালের ভূমিকম্পের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও আশপাশে হওয়া ভূমিকম্পগুলোর কাঠামোগত মিল নেই।

বাংলাদেশে সম্প্রতি যেসব ভূমিকম্প হয়েছে তার ওপর নেপালের ভূমিকম্পের কোনো প্রভাবও নেই। তবে নেপালে যদি ২০১৫ সালের মতো বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তা বাংলাদেশে কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। কিন্তু গত সোমবার ভারতের মেঘালয়ে হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক  ভূমিকম্পের যে কাঠামো তার যোগসূত্র রয়েছে। এই ভূমিকম্প ডাউকি ফল্টের নিচে হয়েছে।

ডাউকি ফল্ট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এটি মেঘালয়ের মালভূমির নিচ দিয়ে গিয়ে হিমালয়ান থ্রাস্ট ফল্টের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই ফাটলতলের ওপর মেঘালয়ের দুই কিলোমিটার উঁচু মালভূমি অবস্থিত।

বর্তমানে ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্ত বাংলাদেশের ভূমিকম্পের প্রধান দুটি উৎসর একটি।

ডাউকি ফল্টে গত ৪০০ বছরে অনেক ভূমিকম্প হয়েছে, বিশেষ করে ডাউকি ফল্টের পশ্চিম প্রান্তে। ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়, যেটা আগে ময়মনসিংহ দিয়ে প্রবাহিত হতো, সেটা বর্তমানে যমুনা দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভারতের আসামে হওয়া ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্প, যেটা গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকুয়েক নামে পরিচিত, সেটা সুনামগঞ্জের কাছাকাছি এলাকায় সংঘটিত হয়। সেই ভূমিকম্পে মেঘালয়, সিলেট ও ময়মনসিংহের বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ঢাকায়ও তখন বেশ কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যদিও তখন ভবনের সংখ্যা কম ছিল।

ওই ভূমিকম্পে মোট এক হাজার ৬২৮ জনের প্রাণহানি হয়। তাদের মধ্যে ঢাকায় সম্ভবত পাঁচজন মারা যায়।

ভূমিকম্পের আরেকটি উৎস হলো সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত, যেটিকে আমরা সাবডাকশন জোন বলি। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎস। এখানে প্রচুর পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে। পৃথিবীর যেসব দেশে, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের চতুর্দিকের দেশগুলো, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ও জাপানে বড় ধরনের ৮ মাত্রার অধিক শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প হয়, সেগুলো সাবডাকশন জোনেই হয়। এতে প্রচুর জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সুনামি সৃষ্টি হয়।

১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সাবডাকশন জোনের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার এলাকায় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেখানকার সঞ্চিত শক্তি বের হয়ে আসে। কিন্তু সাবডাকশন জোনের যে অংশ বাংলাদেশের সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অংশে, সেখানে গত ৮০০ থেকে এক হাজার বছরের মধ্যে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। অর্থাৎ এখানকার সঞ্চিত শক্তি এখনো বের হয়নি। আমাদের গবেষণা বলছে, সেই শক্তির পরিমাণ ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের শক্তির সমান।

সাবডাকশন জোন বলতে একটি প্লেটের নিচে আরেকটি প্লেট তলিয়ে যাওয়াকে বোঝায়। আমাদের এখানে সাবডাকশন জোনে ইন্ডিয়ান প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হাওর হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে আমরা যদি একটি কাল্পনিক রেখা টানি, তাহলে এই বরাবর ইন্ডিয়ান প্লেট পুবের দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

এ বছর আমরা ৩.৫ থেকে ৫.৫ মাত্রার অনেক ভূমিকম্প দেখলাম এবং তার অনেকগুলোই এই সাবডাকশন জোনের মধ্যে। বড় ভূমিকম্পের আগে এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সাম্প্রতিক সময়ের যে ভূমিকম্পগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা আশপাশের এলাকায়, যেমন—মিয়ানমার, ভারতের মণিপুর, মিজোরামে হচ্ছে, এগুলো সবই সাবডাকশন জোনের মধ্যে। এগুলো বড় ভূমিকম্পের লক্ষণ। এই বড় ভূমিকম্প আগামী কয়েক বছরের মধ্যেও হতে পারে বা আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেও হতে পারে। তবে এই সঞ্চিত শক্তি কোনো না কোনো সময় বের হতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

তাহলে আমাদের এখানে দুটি প্রধান উৎস রয়েছে, যেখানে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। একটি হলো ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্ত এবং আরেকটি সাবডাকশন জোন। এখানে ৭ থেকে ৭.৫ মাত্রার শক্তিসম্পন্ন ভূমিকম্প হতে পারে। ডাউকি ফল্টের পূর্ব প্রান্ত সুনামগঞ্জ থেকে ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। সাবডাকশন জোন সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ৩০০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।

এই দুটি উৎস ঢাকা মহানগর থেকে বেশ দূরে (৭০-১২০ কিলোমিটার পরিধির মধ্যে) হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে ঢাকাতেই। কেননা এ ধরনের ভূমিকম্পে যেখানে জনবসতির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, ভবনের অবকাঠামো খুবই দুর্বল, ভূমিকম্পের ব্যাপারে জনগণ সচেতন নয়, সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি—অর্থাৎ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ানোর জন্য যেসব উপাদান বিবেচনা করা হয় সেগুলো সব ঢাকায় রয়েছে।

এই মহানগরী রাতারাতি বদলানো যাবে না। ২০১৫ সালের ৭২০ কিলোমিটার দূরে নেপালের গোর্খায় ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে পাঁচজন মানুষ মারা যায় আতঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে। এ জন্য আমাদের ভূমিকম্পের প্রাথমিক জ্ঞান, সচেতনতা ও করণীয় নিয়ে নিয়মিত বিরতিতে মহড়া ও অনুশীলন দরকার। মানসিক প্রস্তুতি ও জ্ঞান থাকলে আতঙ্কিত কম হবে মানুষ।

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য মহড়া ও অনুশীলনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকার্যে। আমরা যদি আগেই ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারি তাহলে উদ্ধারকার্যে আমাদের অতটা খরচ করতে হবে না।

লেখক

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য,

ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]