শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ নেই, আইএমএফকে জানাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক


অর্থনীতি ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 04-10-2023

শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ নেই, আইএমএফকে জানাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল গত জুনে প্রকৃত (নিট) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকতে হবে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার। শর্ত অনুযায়ী সেই পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

বুধবার (৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ-এর প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শর্ত পূরণের অগ্রগতি, সফলতা ও ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়। বৈঠকে রিজার্ভের শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কথাও জানানো হয়।

আইএমএফ বেশকিছু বিষয়ে নির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে। এই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ফেব্রুয়ারিতে পায় বাংলাদেশ। দেশে এখন ডলার সংকট চলছে। এই সময়ে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরে এই কিস্তি পাওয়ার কথা। তবে তা নির্ভর করছে ঋণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শর্ত পরিপালনের ওপর। তাই সরকারি বিভাগগুলো শর্ত পূরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে।

অংশীজনদের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করবে আইএমএফ। আর্থিক খাতের স্থায়িত্ব, ব্যাংক খাতের সংস্কার, তারল্য ব্যবস্থাপনা, ডলারের বাজারভিত্তিক লেনদেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি, সুদের হার ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এরই অংশ হিসেবে প্রথম দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় বসে সংস্থাটির বিশেষ প্রতিনিধি দল।

বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইএমএফের ঋণের যেসব শর্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পূরণ করার কথা, তার মধ্যে বেশির ভাগ শর্তই পূরণ হয়েছে। তবে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখার শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সেই পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের সময় আমাদের কিছু শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে বেশকিছু শর্ত পূরণ করা হয়েছে। দুই-একটি জায়গায় ব্যর্থতা আছে। রিজার্ভ কিছু কম আছে। রাজস্ব আহরণ কম হয়েছে। তবে অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করেছে। বিপিএমসিক্স অনুযায়ী রিজার্ভ হিসাবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া মুদ্রার বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার প্রবর্তন করা হয়েছে। সুদহারের নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। তাদের দেওয়া যেসব শর্ত অর্জন হয়েছে তা জানিয়েছি আর যেগুলো অর্জন হয়নি সেগুলো কেন হয়নি তাও জানানো হয়েছে।

শর্ত পূরণ ও ব্যর্থতা নিয়ে আইএমএফের পক্ষ থেকে কী বলা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ মুখপাত্র বলেন, আজ কেবল বৈঠক শুরু হয়েছে। তারা (আইএমএফ) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে বসে আলোচনা করবে। প্রথমে তথ্য নিচ্ছে তারপর আবার বৈঠক করবে। আগামী ১৯ অক্টোবর শেষ মিটিং, সেখানে তাদের মতামত জানাবে। আমরাও আমাদের বিষয়গুলো জানাব।

আইএমএফ-এর শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার রাখা, সেপ্টেম্বরে তা ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ কোটি ডলারে রাখতে হবে।

এখন রিজার্ভের তিন ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যেমন মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ। দুই ধরনের হিসাব (মোট রিজার্ভ, বিপিএম ৬) বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করলেও প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে না। তবে প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য নিয়মিত আইএমএফকে জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত জুনে দেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) অনুযায়ী জুনে রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার।

সর্বশেষ ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার আর বিপিএম ৬ অনুযায়ী আছে ২ হাজার ১১৫ কোটি ডলার।

এর বাইরেও প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি তথ্য আছে, যা প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ২০ বিলিয়ন ২ হাজার কোটি ডলারের মতো, যা আইএমএফকে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রকৃত এ রিজার্ভ দিয়ে এখন তিন মাসের আমদানি দায় পরিশোধ করতে পারবে বাংলাদেশ।

এদিকে, গত জুলাই মাসে আমদানি খরচ ছিল ৬৪৬ কোটি ডলার। আইএমএফের দেওয়া লিখিত হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে দেখা গেছে, বিপিএম ৬ অনুযায়ী থাকা রিজার্ভের তুলনায় তা প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার কম। এর মধ্য থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় বাবদ বাদ পড়বে ১০৯ কোটি ডলার, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা ১২৫ কোটি ডলার ও স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এসডিআর) হিসেবে থাকা ২০৪ কোটি ডলার। ফলে প্রকৃত রিজার্ভ কমে ২ হাজার কোটি ডলারে নেমে গেছে।

আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি: গত জুনের মধ্যে রিজার্ভের মজুত হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী শুরু করতে বাংলাদেশকে শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও রিপোর্টিংয়ের মান বাড়ানো। আইএমএফের ঋণের আরও শর্তের মধ্যে রিজার্ভ থেকে গঠন করা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ বাদ দেওয়ার বিষয়টিও ছিল। এছাড়া প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব করতে রিজার্ভের অর্থে গঠন করা লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ) ও গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ), বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজ কিনতে সোনালী ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে দেওয়া অর্থ এবং পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে রিজার্ভ থেকে দেওয়া অর্থ বাদ দেওয়ার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ।

রিজার্ভ যেভাবে তৈরি হয়: রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ থেকে যে ডলার পাওয়া যায় তা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আবার আমদানি ব্যয়, ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ, বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পর্যটক বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়, তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের পর যে ডলার থেকে যায় সেটাই রিজার্ভে যোগ হয়। আর বেশি খরচ হলে রিজার্ভ কমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর থেকে রিজার্ভ কমে এ পর্যায়ে নেমেছে। এর আগে ধারাবাহিকভাবে যা বাড়ছিল। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছর ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এরপর তা বেড়ে ক‌রোনা মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের ২৪ আগস্ট। ওইদিন রিজার্ভ ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার বা চার হাজার ৮০৪ কোটি ডলাররে উঠে যায়। এরপর ডলার সংকটে গত দুই বছর ধারাবাহিকভাবে কমছে  রিজার্ভ।

রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি: বজারে ডলার সংকট কাটাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে ( ২০২১-২২) ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ধারাবাহিক ডলার বিক্রির ফলে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি সঞ্চয় করা রিজার্ভ দুই বছরে ২৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আর প্রকৃত রিজার্ভ নেমেছে ২০ বিলিয়ন ডলারে।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]