নিবন্ধনে আসছে কিন্ডারগার্টেন


অনলাইন ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 01-10-2023

নিবন্ধনে আসছে কিন্ডারগার্টেন

লাগামহীনভাবে চলছে দেশের শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেনগুলো। ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও এর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

 

এসব প্রতিষ্ঠানে কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, দেশে কতগুলো কিন্ডারগার্টেন আছে কিংবা এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত, কিছুই জানা নেই সরকারের। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো কিন্ডারগার্টেন বিদেশি পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করছে দেশের ভাষা-ইতিহাস-ঐতিহ্য। এসব স্কুলে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাড়াও সহায়ক বইয়ের বাড়তি চাপে থাকে শিশুরা। এ ছাড়া ‘গলা কাটা’ টিউশন ও সেশন ফি আদায় করে রমরমা শিক্ষা বাণিজ্য চালাচ্ছে কিন্ডারগার্টেনগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের লাগাম টানতে নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। 

 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি স্কুল চালাতে হলে নির্ধারিত শর্ত মেনে রেজিস্ট্রেশন ও একাডেমিক স্বীকৃতি লাগবে। তা ছাড়া চালানো যাবে না। একাডেমিক স্বীকৃতি দেবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে প্রাথমিকের বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কাছ থেকে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অনুমোদিত পাঠ্যবই অবশ্যই পড়াতে হবে। পাশাপাশি অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি পাঠ্যবই পড়ানো যাবে। তবে ইচ্ছামতো পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

 

সরেজমিন দেখা গেছে রাজধানীর মিরপুর, খিলগাঁও, লক্ষ্মীবাজার কিংবা ওয়ারী এলাকায় সারি সারি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। কেবল খিলগাঁওয়ের এক বর্গকিলোমিটার এলাকায়ই ৪৫টির মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এবং ওয়ারী এলাকায় ডজনখানেক কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এরমধ্যে লক্ষ্মীবাজারের নবদ্বীপ বসাক লেনের গলিতে ৫টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় একই বিল্ডিংয়ে রয়েছে  একাধিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল। রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম মণিপুরে এডু ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামে একটি কিন্ডারগার্টেনের এক বাড়ি পরই দিগন্ত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামে রয়েছে আরেকটি কিন্ডারগার্টেন।

 

এভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে নিয়মনীতি ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন বানিয়ে চালানো হচ্ছে রমরমা শিক্ষা-বাণিজ্য। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিবিহীন এসব স্কুলের শিক্ষকদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের মানদণ্ড না থাকায় শিক্ষার মান নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। ফলে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। এসব প্রতিষ্ঠানে ইচ্ছামতো বিভিন্ন শ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের নির্ধারিত তিনটির বাইরে আরও ৬ থেকে ১০টি বই দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বোর্ডের বাংলা, ইংরেজি, গণিত-এ তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে ধর্ম, পরিবেশ-পরিচিতি, বিজ্ঞান, ওয়ার্ড বুক, চিত্রাঙ্কন, বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা শেখা, সাধারণ জ্ঞান, নামতা-গুণ-ভাগ-জ্যামিতি আছে-এমন একটি গণিত বই, ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, গল্প ও কবিতা এবং কম্পিউটার শিক্ষাসংক্রান্ত বই দেওয়া হয়ে থাকে। স্কুল ভেদে এসব বইয়ের সংখ্যা ও বিষয় কম-বেশি হয়ে থাকে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বিজ্ঞান ও ধর্ম-৬টি সরকারি বইয়ের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে দেওয়া হয় ব্যাকরণ, ইংরেজি গ্রামার, কম্পিউটার, চিত্রাঙ্কন ও দ্রুত পঠন ধরনের দুই থেকে ৬টি বই।

 

সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বৈষম্যহীন ও একই মানের করার কথা বলা হয়েছে। সরকার নির্ধারিত বইয়ের বাইরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়তি বিষয় পাঠ্য করতে চাইলে তার জন্য শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের অনুমতি নেওয়ার কথা বলা আছে। আর শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণয়ন করবে। বোর্ডের অনুমতি ছাড়া শিক্ষাক্রমে অতিরিক্ত কোনো বিষয় বা পাঠ্যবই অন্তর্ভুক্ত করলে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনধিক ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। 

 

এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ব্যাগের বাড়তি ওজনের জন্য নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো মনিটরিং নেই। শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। 

 

তিনি বলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে সরকারের নির্ধারিত বইয়ের সংখ্যা ৬টি। আবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে সেটা ১২টা হয়ে যায়। ৭টা করে ক্লাস হলে ৭টার জন্য কমপক্ষে ৭টা খাতা দরকার হয়। বিষয় কমানো দরকার। আমরা শিশুদের শৈশবের আনন্দ থেকে তাদের বঞ্চিত করছি

যেভাবে নিবন্ধন : 

ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিয়ন্ত্রণে গত ফেব্রুয়ারিতে উদ্যোগ নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিধিমালা প্রস্তুত করে তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সবশেষ আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংও শেষ। এসআরও নম্বর পাওয়ার অপেক্ষা। সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিধিমালাটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। জানা গেছে, বিধিমালা অনুযায়ী দেশে কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি স্কুল নামে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তা আর থাকবে না। সরকারি প্রাথমিক বাদে বাকি সব স্কুল হবে ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। অনিবন্ধিত এসব স্কুলকে বিধিমালার গেজেট জারির ৩ মাসের মধ্যে নিবন্ধন নিতে আবেদন করতে হবে।

বিধিমালার আওতায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানকারী নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি স্কুল এবং অন্য বেসরকারি বিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। অনুমোদনের জন্য উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। আবেদন ফি বিভাগীয় শহরে পাঁচ হাজার টাকা, জেলায় ৩ হাজার এবং উপজেলায় ২ হাজার টাকা।

শিক্ষা কর্মকর্তা প্রাথমিক যাচাই শেষে তা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। তিনিই প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা চলমান প্রতিষ্ঠান চালু রাখার চূড়ান্ত অনুমতি দেবেন। আবেদন করার ৬০ দিনের মধ্যে সব প্রক্রিয়া শেষ করে অনুমোদন বা বাতিল করতে হবে। প্রাথমিক অনুমতির মেয়াদ হবে সনদ দেওয়ার পর থেকে এক বছর। এ মেয়াদ শেষ হলে নবায়নের আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। তদন্ত ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নবায়ন করা যাবে না। প্রাথমিক অনুমোদনের পর নিতে হবে নিবন্ধন। শহরে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার টাকা। জেলায় ১০ হাজার এবং উপজেলায় ৮ হাজার টাকা। নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভর্তি, উপস্থিতি ও শিক্ষা সমাপনের হার বিবেচনায় নেওয়া হবে।

শিক্ষক নিয়োগে নির্দিষ্ট একটি বোর্ড থাকবে। এ বোর্ডে অবশ্যই জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার একজন প্রতিনিধি থাকবেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা থাকলে, তা শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার একমাসের মধ্যে জানাতে হবে। শিক্ষকের বেতন-ভাতা বহন করবে বিদ্যালয়। 

বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে নিবন্ধন পেতে স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হবে ৩০:১, অর্থাৎ প্রতি ৩০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক থাকবেন। ভাড়া কিংবা স্থায়ী ভবনে হোক, মহানগর এলাকায় ন্যূনতম ৮ শতক, পৌরসভায় ১২ শতক এবং অন্য এলাকায় ৩০ শতক জমিতে হতে হবে। ভবন ও ভূমি ভাড়া নেওয়া যাবে। বিধিমালার আগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ভূমির পরিমাণ কম হলে সে ক্ষেত্রে এ নিয়ম কার্যকর হবে না। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ এবং শিক্ষকদের কক্ষ থাকতে হবে। পাঠ্যবই নির্বাচনে যেন দেশের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী কিছু না থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রম থাকতে হবে। ১৯৮৯ সালের জাতিসংঘ শিশু সনদের আলোকে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার, বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেট থাকতে হবে। শিক্ষা সফর, চিকিৎসা, খেলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আমরা চাচ্ছি কোনো বিদ্যালয় যেন একাডেমিক স্বীকৃতি ও নিবন্ধন ছাড়া পরিচালিত না হয়। একাডেমিক স্বীকৃতির জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন দেবেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে একাডেমিক স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত দেবেন। আর নিবন্ধনের জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে বিভাগীয় উপ-পরিচালকের কাছে প্রতিবেদন দেবেন। বিভাগীয় উপ-পরিচালক নিবন্ধনের সিদ্ধান্ত দেবেন। এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরে আসতে হবে না।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]