কমিশন দিয়ে পাচারের অর্থ ফেরানোর চিন্তা


অনলাইন ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 14-09-2023

কমিশন দিয়ে পাচারের অর্থ ফেরানোর চিন্তা

উদ্ধারকৃত অর্থ থেকেই কমিশন দেওয়ার ভাবনা * দূতাবাসের মাধ্যমে পাচারকারীদের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ 

এবার বিদেশি আইনি সংস্থা বা পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কমিশন দিয়ে পাচারের অর্থ ফেরত আনার চিন্তা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে উদ্ধারকৃত অর্থের একটি অংশ কমিশন হিসাবে দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে কাজ চলছে। এর আগে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার পর সেখান থেকে একটি অংশ কমিশন দেওয়ার নজির আছে। কাজেই বিষয়টির আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে এবং আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে পাঁচ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে-দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনস্থ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। এছাড়াও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের ৭ম সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। গত বছরের ২৯ নভেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিনের সভাপতিত্বে অ্যাটর্নি জেনারেলের সভাকক্ষে ওই সভা হয়। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, এনবিআর, পুলিশের অপরাধ বিভাগ, দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বেসরকারি সংস্থা ও আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উদ্ধারকৃত সম্পদের একটি অংশ নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানকে সম্মানি হিসাবে দিতে হয়। বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে জানানো হয়, এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ইতোপূর্বে দুদক বিদেশ থেকে পাচারের অর্থ দেশে ফেরত এনেছে।

তিনি আরও বলেন, পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারের লক্ষ্যে সম্ভাব্য পাচারকারীদের তালিকা প্রণয়ন করা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের পর তালিকা ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে ‘অক্টোখান’ নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা হয়। এর বিনিময়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে উদ্ধারকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কমিশন হিসাবে দেয় দুদক। পরবর্তী সময়ে দুই দফা চুক্তির নবায়ন হলেও ২০১৫ সালের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আর চুক্তি নবায়ন করা হয়নি।

এর আগে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দিয়ে পাচারের অর্থ ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিনা প্রশ্নে ৭ শতাংশ আয়কর দিয়ে অর্থ ফেরানোর সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ কাজে লাগায়নি।। এ কারণে চলতি অর্থবছরে সেই সুবিধা বাতিল করা হয়।

সভায় জানানো হয়, যেসব বাংলাদেশি রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের অর্থের উৎস, পেশা, বাসস্থানের তথ্য সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে নোট ভার্বাল ইস্যু করা হয়েছে। এ বিষয়ে মিশনগুলো তথ্য সংগ্রহে কাজ করছে। নোট ভার্বালের পাশাপাশি মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হবে। এছাড়া কনভার্ট ওয়ে বা ইন্টিলিজেন্সের মাধ্যমেও তথ্য সংগ্রহ করে তালিকা বানানো যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্রভিক্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সেদেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এসব রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের সিংহভাগই সুনির্দিষ্ট ১০ দেশে যায়। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর কম এবং আইনের শাসন আছে, অপরাধীরা সেসব দেশকেই বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং ও থাইল্যান্ড। সাম্প্রতিক সময়ে পাচারের বড় অংশই দুবাইয়ে যাচ্ছে। বড় কয়েকটি গ্রুপ সেখানে অফিস খুলে টাকা পাচার করছে। এছাড়াও বড় অঙ্কের ঘুস লেনদেনের জন্য দুবাই নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, একাধিক কারণে অর্থ পাচার হচ্ছে। বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে ইতোমধ্যে টাকার মান কমে গেছে। ফলে বিত্তবানদের অনেকে বিদেশি মুদ্রায় নিজের সম্পদ রক্ষা করতে চাচ্ছে। অপরদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে তাদের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা জরুরি। এজন্য তারা টাকা বিদেশে রাখতে চাচ্ছে। একদিকে অর্থনৈতিক দুর্বলতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-দুটি একসঙ্গে দেখা দেওয়ায় টাকা পাচার বাড়ছে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা নেই : আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ বা সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে সভায় জানানো হয়। শুল্ক গোয়েন্দা জানায়, বর্তমানে তারা ৭টি মানি লন্ডারিং মামলা তদন্ত করছে। এসব মামলায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ ছাড়া অর্থ পাচার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের ম্যানেজ করেই আইনের ফাঁক গলিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনেই দায়িত্বে অবহেলার বিষয়গুলো উঠে আসছে।

এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে সংঘটিত অর্থ পাচার মামলার তদন্ত শুল্ক গোয়েন্দা ছাড়াও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করা উচিত। কারণ, যোগসাজশ ছাড়া অর্থ পাচার সম্ভব নয়। কাস্টমস কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে বা ম্যানেজ করেই অর্থ পাচার হয়। সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা উদ্ঘাটনও করেছে। তাই কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশের তদন্ত কাস্টমস কর্মকর্তাদের দিয়ে করালে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। তাছাড়া তদন্তের ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে।

দুদকের অনুরোধে সাড়া মিলছে না : অর্থ পাচারের তদন্ত করতে বিভিন্ন দেশে দুদক ৩৪টি এমএলএআর পাঠিয়েছে। এর মধ্যে ২টি অনুরোধের সাড়া পাওয়া গেছে। বাকিগুলোর বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে জবাব পাওয়া যায়নি। তাই কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি করতে (এমএলএ ট্রিটি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ তাদের নিজস্ব ভাষায় এমএলএ অনুরোধ পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে। এসব কারণে এমএলএ অনুরোধের মাধ্যমে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেতে বিলম্ব হয়। এমএলএ-এর বিপরীতে দ্রুত তথ্য পাওয়ার জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ইংরেজি, আরবি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও জাপানিজ ভাষায় অনুবাদের পরামর্শ দেন তিনি।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]