আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করা হবে। বর্তমানে সমুদ্রসীমায় কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তা জানার জন্য মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভের কাজ চলছে।
জরিপের কাজ ৭০ শতাংশ শেষ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনের আগে জরিপকাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই এই সময়ে দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আশা করছেন, চলতি বছরের মধ্যে জরিপের ফলাফল পাওয়া যাবে।
এ কারণে নির্বাচনের পরই দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, সার্ভের সব তথ্য হাতে পাওয়ার আগে যদি বিডিং দেওয়া হয়, তাহলে সমস্যা হবে। পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে পেয়ে বিডিংয়ে যাওয়া ভালো।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, জরিপের তথ্য বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সন মবিলের প্রস্তাব নিয়েও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও তিনি জানান। যদিও কোম্পানিটি সরকারের কাছে চলতি মাসে তাদের সঙ্গে এমওইউ সম্পন্ন করার প্রস্তাব দিয়েছে।
একই সঙ্গে তারা নভেম্বরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি টুডি সিসমিক সার্ভে করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ কাজে তারা ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। সংবিধান অনুযায়ী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হওয়ার কথা।
সম্প্রতি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মডেল পিএসসি (উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটাতে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোরেশোরে কাজ শুরু করেছে সরকার। কারণ, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাসের বড় মজুত পেয়েছে।
পিএসসি বা উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তির ভিত্তিতে সাগরে তেল-গ্যাসের হিস্যা, দরসহ অন্যসব বিষয় নির্ধারিত হয়। এতদিন মডেল পিএসসিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। এখন প্রতিবেশীদের চেয়ে মডেল পিএসসিতে বেশি সুবিধা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সমুদ্রে আহ্বান করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম বলেছেন, ‘আমরা মডেল পিএসসিতে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর (আইওসি) জন্য সবচেয় বেশি সুবিধা রাখতে যাচ্ছি।’
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, মডেল পিএসসির তিনটি জায়গা নিয়ে তারা কাজ করেছে। প্রথমত, আগের তুলনায় নতুন পিএসসিতে দাম বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে কস্ট রিকভারি (গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন খরচ তুলে নেওয়ার পরিমাণ) বৃদ্ধি করা হয়েছে। গভীর ও অগভীর সমুদ্রে গ্যাস রপ্তানির বিধান রাখা হয়েছে।
এখনকার পিএসসিতে গভীর সমুদ্রে প্রতি ইউনিট সোয়া ৭ ডলার এবং অগভীর সমুদ্রে গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে সাড়ে ৫ ডলার। এখন পিএসসিতে গভীর সমুদ্রে সোয়া ৭ ডলারের সঙ্গে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে এর কর দিয়ে দেওয়া এবং প্রতিবছর দেড়ভাগ হারে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিধান সংযোজন করা হয়েছে। তবে অগভীর সমুদ্রে এ দুই সুযোগের কোনোটি নেই।
সূত্র বলছে, নতুন পিএসসিতে গ্যাসের হিস্যা হবে অর্ধেক অর্ধেক। অর্থাৎ, আইওসি যা-ই উত্তোলন করুক না কেন, তারা সেই গ্যাসের অর্ধেক ভাগ পাবে।
আগের পিএসসি অনুযায়ী ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করলে পেট্রোবাংলা পেত ৫৫ ভাগ, আইওসি পেত ৪৫ ভাগ। এভাবে ১৫০ মিলিয়ন উত্তোলনে পেট্রোবাংলা ৬০ ভাগ, আইওসি ৪০ ভাগ এবং ২৫০ মিলিয়নের ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা ৬৫ ভাগ ও আইওসি ৩৫ ভাগ গ্যাস পেত। আর ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন হলে পেট্রোবাংলা ৮০ ভাগ এবং আইওসি ২০ ভাগ গ্যাস পেত। অর্থাৎ, আইওসি যত বেশি গ্যাস উৎপাদন করত, তারা তত কম গ্যাস পেত। এখন সেটিকে সমান করে দেওয়া হয়েছে।
গত এক দশকে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ ফেলে চলে গেছে। কোরিয়ান কোম্পানি দাইয়ু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা ইজারা নিয়েও কাজ শেষ করেনি। ভারতের ওএনজিসি সম্প্রতি অগভীর সমুদ্রে একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করে হতাশ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সর্বমোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্রসীমার ওপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে গভীর ও অগভীর সাগরে ২৬টি ব্লক রয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, এতদিন সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকারের আগ্রহ থাকলেও কোনো জরিপের তথ্য না থাকায় বাংলাদেশের আহ্বানে সেভাবে সাড়া দেয়নি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো (আইওসি)। এবার নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ভেঞ্চার টিজিএস-স্লামবার্জার (এসএলবি) এই সার্ভে করছে। ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর আগ্রহও বেড়েছে। ইতোমধ্যে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সন মবিলের প্রস্তাব পাওয়া গেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এক্সন মবিলের অফারটা বিবেচনার মধ্যে আছে। আমরা একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে তাদের প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করব। তারপর তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এবার মনে হচ্ছে এক্সন মবিল বেশ সিরিয়াসলি এগিয়ে আসছে। প্রাথমিকভাবে এক্সন ১০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায় বলে জানান তিনি।