চার্লি চ্যাপলিনের জানা-অজানা কাহিনী


তামান্না হাবিব নিশু , আপডেট করা হয়েছে : 13-08-2023

চার্লি চ্যাপলিনের জানা-অজানা কাহিনী

মানুষকে হাসানোর যতটা সহজ মনে হয় আসলে ততটা সহজ নয়। আমাদের মনে হয় যারা সিনেমা বা স্ট্যান্ড আপ কমেডি করে থাকেন, তাদের কতটাই বা কষ্ট আছে! তারা তো দিব্যি রয়েছেন! কিন্তু আসলেই হয়তো তেমনটা নয়।

দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কমেডিয়ান এবং অ্যাক্টরের সম্পর্কে এই প্রতিবেদন, যার নাম শুনলে আমাদের মুখে এক ঝলক হাসি ফুটে ওঠে।

হ্যাঁ, ঠিকই অনুমান করেছেন, যার কথা বলা হবে তাঁর নাম, দি গ্রেট চার্লি চ্যাপলিন, যার কর্ম মানুষকে বুড়ো থেকে শিশুতে পরিণত করলেও তার জীবনে কিছু চড়াই-উত্‍রাই ঘটনা ঘটেছিল। এমনকি চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যু এবং মৃত্যুর পরও তাঁকে ঘিরে এক রহস্য সৃষ্টি হয়েছিল।

এই মহান ব্যক্তি চার্লি চ্যাপলিনের জন্ম হয়েছিল ১৬ই এপ্রিল ১৮৮৯ সালে লণ্ডন শহরে। তাঁর পিতা ছিলেন চার্লস স্পেন্সার চ্যাপলিন এবং মাতা ছিলেন হেনা চ্যাপলিন, যিনি মিউজিক থিয়েটারের গায়িকা এবং জুনিয়ার আর্টিস্ট ছিলেন। এই কারণেই আর্ট চার্লি চ্যাপলিনের ছোটবেলা থেকেই রক্তে মিশেছিল। ছোটবেলা থেকেই আর্ট তাকে যেভাবে ঘিরে রয়েছে তার পেছনে একটি কাহিনী ছিল।

চার্লি যখন ছোট ছিলেন, তাঁর মাতা হেনা চ্যাপলিন একদিন স্টেজে গান প্রদর্শন করার সময় হঠাত্‍ তাঁর আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে থাকা দর্শকেরা চার্লির মাকে ঘিরে জুতো-চপ্পল ছুটতে শুরু করে। এমন অবস্থায় তার মাকে বাঁচাতে ৫ বছরের চার্লি স্টেজে উঠে পড়েন এবং দর্শকেদের বিভিন্ন গল্প কাহিনী বলে আনন্দিত করেন। দর্শকরা এই শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং স্টেজে পয়সার বন্যা বয়ে যায়।

পাঁচ বছর বয়সে এটি ছিল চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের প্রথম ইনকাম। তারপর থেকে চার্লি এই বিষয়টি নিয়ে নিজের মনস্থির করে নেয়। আসলে তাঁর নিজের দুঃখভরা কাহিনী সেদিন তিনি স্টেজে মজার ছলে বলেছিলেন, তাতেই দর্শকেরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি এরপর থেকে ভেবে নেন, তাঁর দুঃখ ভরা কাহিনী যদি মানুষেরা মজার ছলে শুনতে এত পছন্দ করেন তাহলে এটাকেই তিনি হাতিয়ার বানাবেন। এজন্য তারপর পরবর্তী এপিসোড গুলোতে দেখা গিয়েছিল, তিনি বিভিন্ন দরিদ্রতাকে অনুসরণ করে কমেডি ভিডিও তৈরি করতেন। আর এটা দেখে মানুষেরা অনেক বেশি মজা পেত।

যাই হোক এই ঘটনার কিছুদিন পর চার্লির মাতা-পিতা পারিবারিক অশান্তির কারণে দুজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চার্লি, তাঁর মাতা এবং তার ভাই অনাথ আশ্রমে থাকতে শুরু করে, কারণ চার্লির মায়ের কাছে কোনও চাকরি ছিল না। সেই অনাথ আশ্রমে থাকতে থাকতে চার্লির মাতা মানসিক দিক থেকে ডিসব্যালেন্স হয়ে যায়। এরপরে চার্লি ও তাঁর ভাইকে পিতার কাছে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। এদিকে চার্লির পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করে নিয়েছিলেন। সুতরাং সত্‍ মায়ের কাছ থেকে তারা শুধু লাঞ্ছনা এবং বেদনা সহ্য করতেন।

এর কিছুদিন পর চার্লির মাতা পাগলাগারদ থেকে ঠিক হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। কিছুটা পরিস্থিতি চার্লি ও তার ভাই ঠিক হয়ে যায়, তারা স্কুলে যেতে শুরু করেন। কিন্তু চার্লির পড়াশোনায় মন বসত না। তিনি চাইতো একজন অভিনেতা হতে। পয়সা ইনকামের জন্য তিনি তখন থেকে স্টেজ শো করতে শুরু করেন। ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে তিনি অত্যন্ত সামান্য কাজকর্ম করতে থাকেন। আসলে ওনার জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিল তাঁকে একজন অভিনেতা হতে হবে। এজন্য তিনি ব্ল্যাক মোড় থিয়েটারে যেতেন। একবার তিনি স্টেজ শো প্রদর্শন করছিলেন, এমন সময় এক ডিরেক্টরের নজর তাঁর দিকে পড়ে। ডিরেক্টর তখনই চার্লির সুপ্ত ট্যালেন্টকে তাঁর অভিনয়ে দেখে বুঝতে পেরে যায়। ওই ডিরেক্টরের মাধ্যমে চার্লির পরিচয় হয় হ্যামাল্টনের সাথে। হামাল্টন, চার্লিকে শার্লক হোমসে অভিনয়ের জন্য প্রপোজাল অফার করে। কিন্তু চার্লি পড়তে পারতেন না, তাই তিনি ডায়লগ শুনে শুনে মনে রাখতে শুরু করেন।

শার্লক হোমস সিরিজের অভিনয় করে তিনি রাতারাতি অনেক দর্শকের মন জয় করে নেয়। কিন্তু তারপরও তাঁর জীবনে অভিশপ্তের ছায়া কিছুটা থেকেই যায়। চার্লি ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি বেঁটে উচ্চতার রোগা-পাতলা মানুষ ছিলেন। তিনি তার অভিনয়ের মাধ্যমে দরিদ্রতাকে কখনই বুঝতেই দেয়নি। তিনি মানুষকে জীবনে হাসিখুশি থাকার প্রেরণা দিতেন। তার সাক্ষী আছে ইতিহাস।

১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গোটা বিশ্বজুড়ে যখন সংঘর্ষ চলছিল, চার্লি তখন নিজের কমেডি শো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ঠিক তখনই চার্লির অজান্তে আমেরিকা সরকার একটি তদন্ত কমিটি এফবিআই-এর হাতে তুলে দেয়। সেই তদন্তে চার্লির ওপর আরোপ লাগানো হয়, তিনি নাকি অন্য কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত আছেন এবং কম বয়সী মহিলাকে বিবাহ করেছেন। এই নিয়ে আমেরিকা সরকারের সাথে চার্লির এক দ্বন্দ্ব বিক্ষোভের আবির্ভাব হয়। দশ বছর ধরে মিডিয়া এবং আমেরিকা সরকার চার্লির ওপর এই আরোপ লাগাতে থাকে। সেই সময় তৈরি হওয়া চার্লির সিনেমা লাইমলাইট ১৯৫২ সালে রিলিজ হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা সরকার সেই সিনেমাকে বাজেয়াপ্ত করে দেয়। চার্লির সাথে আমেরিকার এক বিশাল দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

তিনি তার প্রথম বিবাহ ওই আমেরিকাতেই করেছিল। ওনা ওনেইল নামে এক মহিলাকে। অবশেষে আমেরিকার এই দীর্ঘমেয়াদী ঘাত-প্রতিঘাতে তিনি ভেতর থেকে একদম ভেঙে পড়েন এবং সিদ্ধান্ত নেয় তিনি আমেরিকার নাগরিকত্ব ত্যাগ করবেন। পরিবর্তে তিনি এবং তার স্ত্রী আমেরিকা ছেড়ে লণ্ডনে আসে কিন্তু লন্ডনে উপযুক্ত থাকার জায়গা না পেয়ে তিনি সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা হয়ে যায়। এখানে এসে তাঁর পরিচয় হয় জহরলাল নেহেরু এবং তাঁর কন্যা ইন্দিরার সাথে। তার জীবনীতে লিখে গিয়েছিলেন তিনি মহাত্মা গান্ধীর বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্রেরণা নিতেন।

একবার চার্লির পরিচয় হয় ব্রিটেন প্রধান মন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের সাথে। তিনি তখন গান্ধীজীর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেন‌। তখন সৌভাগ্যবশত ওই সময় গান্ধীজি লণ্ডনে এসেছিলেন আর সেখানে চার্লির সাথে গান্ধীজির সাক্ষাত্‍ হয়। গান্ধীজি এক গোপনীয় জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে চার্লি এসে হাজির হয় এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত্‍ করেন। তখন চার্লি ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য গান্ধীজিকে সাপোর্ট দেয়‌।

চার্লি তাঁর অভিনয় এবং কমেডির জন্য অজস্র পুরষ্কার জিতেছিলেন। ১৯৪০ সালে দি গ্রেট ডিক্টেটরের জন্য তাকে বেস্ট অ্যাক্টর এবং ১৯৫২ সালে তাঁর মুক্তি পাওয়া সিনেমা লাইমলাইটের জন্য অস্কার পুরষ্কার জিতেছিলেন। সেই সময়ে বিশ্বের দেশে বেশিরভাগ মানুষের চার্লি পছন্দ ছিলেন এবং এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্ব চার্লিকে চেনেন। আট থেকে আশি ওনার অভিনয় হেসে ওঠেন এবং অনেক অভিনেতা আছেন যারা চার্লির অভিনয়কে কপি করার চেষ্টা করেন।

একবার যখন চার্লির সাথে সাক্ষাত্‍ হয়েছিল স্যার আলবার্ট আইনস্টাইনের। তিনি চার্লিকে বলেছিলেন, "আমি আপনার অন্ধ ভক্ত হয়ে গিয়েছি। আপনি কাউকে একটি কথা না বললেও তবুও গোটা দুনিয়া আপনাকে বুঝে যায়।" এর উত্তরে চার্লি বলেন, " আপনি যখন নতুন কিছু আবিষ্কার করেন সবাই আপনাকে প্রশংসা করে কিন্তু আপনার থিওরি জানা সত্ত্বেও তারা কিছুই বোঝে না তবুও তারা প্রশংসা করে।" আইনস্টাইন এই কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যান, সত্যি তো এটা ছিল একটি গভীর চিন্তা।

মাইকেল জ্যাকসনও, চার্লি চ্যাপলিনের সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি চার্লির মতো হতে চায়। কারণ ওনার জীবন দুঃখে ভরা চোখে জল থাকলেও হাসিখুশি ভাবে বেঁচে থাকার এক অনুপ্রেরণা জাগায়।

চার্লির গোটা জীবন কাল সুখ-দুঃখে থাকলেও অবশেষে মৃত্যুর পর ওনার সাথে ঘটে যায় এক অন্যরকম কাহিনী। দি গ্রেট চার্লি চ্যাপলিনের মৃত্যু হয় ২৫শে ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে। তারপর তাঁকে সুইজারল্যান্ডের কবর দেওয়া হয়। কিন্তু রহস্যময় ঘটনা ঘটে চার্লির মৃত্যুর তিন মাস পর। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, তিন মাস পর তার কবর থেকে দেহ উধাও হয়ে গিয়েছিল। পরে বোঝা যায়, ওই দেহ চুরি হয়ে গিয়েছিল।

জানা যায়, বুলগেরিয়ার দুই জন মেকানিক কবর থেকে খুঁড়ে চার্লির দেহ চুরি করে ফেলেছিল। যদিও এই চুরির পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ওদের দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। চোরেরা চুরি করার পর অনেক টাকার ডিমান্ড করেছিল দেহ ফেরত দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই তারা গ্রেফতার হয় এটাই ছিল চার্লির জীবনের সম্পূর্ণ কাহিনী, যিনি মৃত্যুর পরও এত বছর এখনও মানুষকে হাসিয়ে চলেছেন।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]