ডিজিটাল বাংলাদেশে আইসিটি ইন্ডাস্ট্রির প্রথম হাইটেক পার্ক যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক এগিয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে। এখানে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত আইটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যারা দেশের অভ্যন্তরে আইটি সেবা প্রদানের পাশাপাশি অনলাইন মার্কেট প্লেসগুলোতে কাজ করেও আয় করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এসব প্রতিষ্ঠানে আইটিসংশ্লিষ্ট প্রায় ২ হাজার কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে এখনো এই পার্কে কিছু সমস্যা থেকে গেছে। এগুলোর সমাধান করতে পারলে এখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় যেমন আরও বাড়ানো সম্ভব, তেমনি আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম হাইটেক পার্ক হিসেবে যশোরের ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’টি উদ্বোধন করেন।
শহরের নাজিরশংকরপুর এলাকায় ১২ একর জায়গার ওপর এ পার্কটি গড়ে তুলতে সরকারের ব্যয় হয় ৩১০ কোটি টাকা। বিশাল এ জায়গায় আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে ১৫ তলা ও ১২ তলাবিশিষ্ট দুটি দৃষ্টিনন্দন ভবন রয়েছে। দুটি ভবনই ভূমিকম্প প্রতিরোধক স্টিল ও কংক্রিটের কম্পোজিট কাঠামোতে তৈরি করা। ১৫ তলাবিশিষ্ট এমটিবি ভবনের পুরোটাই বিনিয়োগকারীদের জন্য বরাদ্দ। ১২ তলাবিশিষ্ট ভবনটি ডরমেটরি হিসেবে তৈরি করা হলেও বর্তমানে সেটিকে রিসোর্টে রূপান্তর করা হয়েছে। এখানকার আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদানের জন্য রয়েছে ২ হাজার কিলোওয়াট ক্ষমতার জেনারেটর। পার্কের সীমানার মধ্যেই পাঁচ একর জায়গার ওপর রয়েছে বিশাল জলাধার।
শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ডেটা সংরক্ষণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে দেশের দ্বিতীয় সার্ভার স্টেশন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত প্রথম সার্ভার স্টেশনের ব্যাকআপ এটি। কোনো কারণে গাজীপুরের সার্ভার স্টেশনে সমস্যা হলে যশোরের এই সার্ভার থেকে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য উদ্ধার করা যাবে।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলাকে টার্গেট করেই যশোরে এই আইটি পার্কটি স্থাপন করে সরকার। এ অঞ্চলের আইটি উদ্যোক্তারা সরকারের তৈরি করা এই অবকাঠামোগত সুবিধা ব্যবহার করে আইটি খাতকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো. শাহজালাল জানান, পার্কটিতে এখন ৫৭টি আইটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অপারেশনে আছে ৪৪টি। তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান মূলত সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ইকমার্স, গ্রাফিকস ডিজাইন, কল সেন্টার, ইন্টারনেট সেবা প্রদান, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন, অ্যানিমেশনসহ বিভিন্ন ধরনের আইটি সেবা প্রদান করছে। এগুলোর মধ্যে আবার ১৫-১৬টি প্রতিষ্ঠান অনলাইন মার্কেস প্লেসগুলোতে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে। মো. শাহজালাল বলেন, এ পার্কে এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার আইটি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে সরকার যদি এখানকার বিনিয়োগকারীদের জন্য স্পেস ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল কমিয়ে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা এবং বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে, তাহলে দ্রুতই এখানে কর্মসংস্থানের সংখ্যা দ্বিগুণ করা সম্ভব। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণও বাড়বে অনেক।
২০১৪ সাল থেকে ফ্রিল্যান্স প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছেন মাইক্রোড্রিম আইটির কর্ণধার শাহানুর মো. শরিফ। প্রথমে শহরের মধ্যে থাকলেও পরবর্তী সময়ে আইটি পার্কে তার প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তর করেন। তিনি বলেন, ‘একটি কাজের জন্য অনেক ধরনের সার্ভিসের প্রয়োজন হয়। বাইরের দেশের একজন ক্লায়েন্টেরও বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস লাগে। বিচ্ছিন্নভাবে থাকা কোনো আইটি প্রতিষ্ঠান এক ক্লায়েন্টের সব ধরনের সার্ভিস দিতে পারে না। শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বিনিয়োগকারীদের সেই সুবিধাটা করে দিয়েছে। এখানে একই ছাদের নিচে প্রোগ্রামার, গ্রাফিকস ডিজাইনার, অ্যানিমেশন মেকার, ডিজিটাল মার্কেটার সবই আছে। একটা মাল্টি সার্ভিস হাব তৈরি হয়েছে। আগে বিদেশি কোনো ক্লায়েন্টের একটা কাজ হয়তো আমরা করতাম, বাকি কাজগুলো অন্য কোনো দেশের আইটি কর্মীদের দিয়ে তিনি করিয়ে নিতেন। এখন সব কাজই আমরা করে দিতে পারছি। এটা এখানকার বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় একটা সুবিধা।’ তবে এখানকার ফ্রিল্যান্সারদের কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও বলেন তিনি। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে কথোপকথনের জন্য ইংরেজি কোর্সের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেন শাহানুর শরিফ। অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ করেন ভিক্স আইটির কর্ণধার ভিক্টর সাহা। তিনি বলেন, আগে স্থানীয়ভাবে যারা আইটির কাজ শিখতেন, তারা সবাই ছিলেন ঢাকামুখী। কিন্তু যশোরে আইটি পার্ক হওয়ার পর এখানে এই কর্মীদের কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা আর রাজধানীমুখী হচ্ছেন না। এটা একটা বড় পাওয়া। এখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় আরও বাড়ানোর জন্য সরকারকে ট্রেনিংয়ে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তবে সে ক্ষেত্রে পেশাদার ট্রেইনারদের পরিবর্তে যারা কাজের মধ্যে আছেন, তাদের দিয়েই ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করার পরামর্শ তার।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এখানকার প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই দক্ষ আইটি কর্মীর সংকট আছে। ঢাকা থেকে দক্ষ আইটি কর্মীদের যশোরে আনা সম্ভব নয়। সে কারণে যশোরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করে যদি দক্ষ আইটি কর্মী তৈরি করা যায়, তাদের দিয়ে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ককে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।