বাংলা ও ইংরেজির মতো হিজরি বছরও ১২ মাসে সীমাবদ্ধ। তবে বাংলা-ইংরেজির তুলনায় হিজরি সনের দিনের সংখ্যা কম। বছর বা সন গণনার বিষয়টি আসমান-জমিন সৃষ্টির আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল বলে কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
‘আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে গণনায় মাসসমুহের সংখ্যা ১২টি। যা আল্লাহর কিতাবে (লৌহ মাহফুজে) লিপিবদ্ধ রয়েছে। তার মধ্যে চারটি মাস (রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম) হারাম (নিষিদ্ধ/সম্মানের)। এটা হল সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ৩৬)
সম্মানিত নির্ধারিত এ ৪ মাস সম্পর্কে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে-
‘বছরে ১২টি মাস রয়েছে; তন্মধ্যে ৪টি মাস হারাম (সম্মানিত মাস)। তিনটি মাস পর্যায়ক্রমে ধারাবাহিক- জিলকদ, জিলহজ ও মহররম আর অন্যটি হচ্ছে রজব মাস।’ (বুখারি)
মহাররমের গুরুত্ব: মহররম অর্থ সম্মানিত। এ মাসটি কতগুলো ঘটনার জন্য উল্লেখযোগ্য এবং স্মৃতিবিজড়িত। এসব ঘটনা ও মর্যাদার কারণেই মহররম মাসের গুরুত্ব অত্যাধিক। কোরআনুল কারিমে এ মাসকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
মহররম নামকরণ: হিজরি বছরের প্রথম মাসকে মহররম হিসেবে নামকরণ করার অন্যতম কারণ হলো- এটি হারাম মাস; যাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ; রক্তপাত করা হারাম বা নিষিদ্ধ। এ বিষয়টির প্রতি তাগিদ দিতেই হজরত ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু মহররমকে হিজরি সনের প্রথম মাস করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাব অনুসারেই হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে মহররমকে নির্ধারণ করা হয় এবং নিষিদ্ধের জন্য মহররম নাম রাখা হয়।
মহররমের সতর্কতা: আল্লাহর পক্ষ থেকে মহররম মাস সতর্কবার্তা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন, فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ অর্থাৎ এই সময়ের (মহররম মাসের) মধ্যে তোমরা নিজেদের উপর জুলুম করো না।’ আল্লাহর পক্ষ থেকে হারামকৃত ৪ মাসের মধ্যে তোমরা একে-অপরের প্রতি জুলুম করো না। এই মাসে পাপাচার থেকে বিরত থাকার প্রতি বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা সব মাসেই জুলুম করতে নিষেধ করেছেন। তবে বিশেষভাবে হারামকৃত এই ৪ মাস মহররমসহ জিলকদ জিলহজ ও রজব মাসে জুলুম-পাপাচারে লিপ্ত হওয়া থেকে রিবত থাকার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন।
হজরত কাতাদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, যদিও অন্যান্য মাসে জুলুম ও পাপাচার বড় গোনাহ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে তবে হারামকৃত অর্থাৎ নিষিদ্ধ এই মাসগুলোতেও জুলুম-পাপাচারে লিপ্ত হওয়া সবচেয়ে বড় গোনাহ।
মহররমের রোজা: হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রমজান মাসের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে- আল্লাহর হারামকৃত (চার) মাসে রোজা পালন করা।’ (মুসলিম)
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা পালনের বিষয়টি প্রমাণিত হলেও তা হারামকৃত (চার) মাসের চেয়ে উত্তম নয়।
আশুরার ফজিলত: তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম আশুরা। হাদিসে পাকে আশুরার অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। তাহলো-
১. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তারা জানালো, এ দিন মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবিদের বললেন, মুসা আলাইহিস সালামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার দিক থেকে তাদের চেয়ে তোমরাই অধিক হাকদার। কাজেই তোমরা (আশুরার দিন) রোজা রাখ।’ (বুখারি)
২. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আশুরার দিন সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন, এই দিন জাহেলি যুগের লোকেরা রোজা রাখত…।’ (মুসলিম)
৩. হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, জাহেলি যুগে মক্কার কুরাইশ বংশের লোকেরা আশুরার রোজা রাখত এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও আশুরার রোজা রাখতেন।’ (মুসলিম)
আশুরায় রোজা রাখার হুকুম কী?
আশুরার রোজা রাখা মোস্তাহাব। সেই সাথে ১০ তারিখের আগে ৯ তারিখও রোজা রাখা মোস্তাহাব। হাদিসে এসেছে-
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মহররম মাসের ১০ তারিখে নিজে রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন তখন সাহাবাগণ বললেন- হে আল্লাহর রাসুল! এই দিনকে ইয়াহুদি-নাসারারাও মহান দিন হিসেবে পালন করে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যখন সামনের বছর আসবে তখন ইন শা আল্লাহ আমরা ৯ মহররম রোজা পালন করব। হজরত ইবনে আব্বাস(রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, পরবর্তী বছরের মহররম মাস আসার আগেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল করেছিলেন।’ (মুসলিম)
এ কারণেই হজরত ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল এবং ইসহাকসহ অন্যান্যরা ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখও রোজা রাখাকে মোস্তাহাব মনে করতেন। কেননা ১০ তারিখে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রোজা রেখেছেন আর ৯ তারিখে রোজা রাখার ইচ্ছা করেছিলেন।
আশুরায় নবিজির রোজা
সময়ের অবস্থাভেদে নবিজির আশুরার রোজা পালনের ৪টি অবস্থা ছিল। তাহলো-
১. মক্কায়
তিনি মক্কায় অবস্থানকালীন সময়ে নিজে আশুরার রোজা পালন করেছেন কিন্তু কাউকে সে সময় রোজা রাখতে নির্দেশ দেননি।
২ মদিনায়
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করলেন, তখন ইয়াহুদিদেরকে এই দিনে রোজা রাখতে দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করে জানার পর তিনিও এই দিনে রোজা পালন করাকে পছন্দ করলেন এবং সাহাবাদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।
৩. দ্বিতীয় হিজরিতে
হিজরি দ্বিতীয় বছরে যখন রমজানের রোজা ফরজ হয় তখন তিনি সাহাবাদেরকে আাশুরার রোজা রাখার আর নির্দেশ দেননি। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তিনি সাহাবাদেরকে আর নির্দেশও করেননি আবার নিষেধও করেননি।
৪ নবিজির ইন্তেকালের আগে
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের আগে তিনি ও তার সাহাবায়ে কেরামগণ সকলে শুধু মহররমের ১০ম তারিখ রোজা রাখতেন। কিন্তু সাহাবাগণ যখন অভিযোগ জানালেন যে, এই দিনটিতে ইয়াহুদিরাও উৎসবের দিনে হিসেবে গণ্য করে থাকে এবং রোজা রাখে; তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমি যদি পরবর্তী বছর বেঁচে থাকি তবে ইন শা আল্লাহ ৯ তারিখও রোজা পালন করব।’
উল্লেখ্য, ইমাম কুরতুবি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহারে বর্ণনা থেকে জানা যায়, জাহেলি যুগে (মক্কার) কুরাইশরাও আশুরার রোজা রাখতো। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, জাহেলি যুগেও এই দিনটি তাদের কাছে পরিচিত ছিল। সম্ভবত এটি হজরত ইবরাহহিম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালামের শরিয়তও ছিল। কারণ মক্কার কুরাইশরা ছিল হজরত ইবরাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালামের অনুসারী। আর মদীনার ইয়াহুদিগণ ছিলো হজরত মুসা আলাইহিস সালামের অনুসারী।
মহররমে সফরে থাকলে...
হজরত আবু জাবালাহ থেকে মুআবিয়াহ বিন সালিহ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি ইমাম জুহরি (ইবনু শিহাব) এর সঙ্গে সফররত অবস্থায় ছিলাম। তিনি আশুরার রোজা রাখলে তাকে বলা হলো- আপনিকি সফররত অবস্থায় আশুরার রোজা রাখবেন? অথচ সফর অবস্থায় রমজানের ফরজ রোজা রাখার ব্যাপারে রুখসাত রয়েছে?
উত্তরে তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই রমজানের রোজা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, সফর অবস্থায় থাকলে রমজান পরবর্তী দিনগুলোতে তা আদায় করে নেবে। কিন্তু আশুরার ব্যাপারে এ ধরণের কোনো বক্তব্য নেই, যদি তুমি সফর অবস্থায় আশুরার রোজা ছেড়ে দাও তাহলে এর ফজিলত ছুটে যাবে।
হজরত ইবনে রজব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, সালাফদের একটি অংশ; তারা সফরাবস্থায়ও আশুরার রোজা রাখতেন। তারা হলেন- হজরত ইবনে আব্বাস, আবু ইসহাক, ইমাম জুহরি প্রমুখ।
ভাংতি ফরজ রোজা থাকলে...
শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমিন রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা কাজা থাকা অবস্থায় আশুরার দিন আশুরার নিয়তে রোজা রাখবে তার রোযা শুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যদি এই (আশুরার) দিনে তার কাজা (ফরজ) রোজা রাখে তবে সে দুইটি সাওয়াবই অর্জন করবে। তার কাজা রোজার সাওয়াব এবং আশুরার রোজার সওয়াব।’ (ফাতাওয়া আল-উসাইমিন)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, মহররমের ফজিলত ও মর্যাদা রক্ষায় যে কোনো ঝগড়া-বিবাদ, রক্তপাত ও জুলম-অত্যাচার থেকে বিরত থাকা। আশুরার রোজা পালন করা। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করা। বছরের বাকি সময়ের জন্য মহররমের শিক্ষাকে গ্রহণ করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মহররম মাসের মর্যাদা রক্ষার তাওফিক দান করুন। আশুরার রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। বিগত এক বছরের সগিরাহ গোনাহ থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।