সমুদ্রে বিশাল বিনিয়োগে আগ্রহী মার্কিন কোম্পানি


অনলাইন ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 20-07-2023

সমুদ্রে বিশাল বিনিয়োগে আগ্রহী মার্কিন কোম্পানি

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ৩০ বিলিয়ন (তিন হাজার) ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৮.৫০ টাকা ধরে)। আগামী আগস্টের মধ্যে এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করার আগ্রহ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে চিঠি দিয়েছেন এক্সন মবিলের নিউ অপরচুনিটি ম্যানেজার জনাথান উইলসন। গত ১৬ জুলাই রবিবার বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে এই চিঠি পাঠিয়েছে মার্কিন কোম্পানিটি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এর আগে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে গেছেন এক্সন মবিলের কর্মকর্তারা। এর পরই এই চিঠি পাঠানো হয়।

চিঠিতে মার্কিন কোম্পানিটি বলেছে, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এবার দ্বিমাত্রিক (টুডি) ও ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) জরিপ করতে চায় তারা। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি সাগরের ১৫টি ব্লকের সব ইজারা চেয়েছিল। তবে তাদের এবারের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে জ্বালানি বিভাগ সূত্র।

এক্সন মবিল চিঠিতে জানিয়েছে, গভীর সমুদ্রে সম্পদ অনুসন্ধানে দ্বিমাত্রিক জরিপে ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। এতে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে ত্রিমাত্রিক জরিপ করা হবে। এতে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ছাড়া প্রতিটি কূপের উন্নয়নে ৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি গভীর সাগরে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে ১০ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার আগ্রহ দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পুরো প্রক্রিয়া সফল হলে বাংলাদেশের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির তুলনায় প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সাশ্রয় হবে।

মার্কিন কোম্পানির প্রস্তাব নিয়ে জ্বালানি বিভাগ কাজ করছে বলে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোতে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কয়েক দফা চিঠি দিয়ে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে।’

গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলো ইজারা দিতে বেশ কয়েকবার টেন্ডার আহ্বান করেও সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এক্সন মবিল বারবার আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বিষয়টি এখন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি এখন মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।’

চূড়ান্ত চুক্তির আগে আগামী আগস্টের মধ্যে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছে এক্সন মবিল। তাদের যুক্তি, এমওইউ সই হলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সুবিধা হবে।

গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহ দেখিয়ে এ পর্যন্ত দুই দফায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে এক্সন মবিল। প্রথম দফায় গত মার্চে পেট্রোবাংলার কাছে প্রস্তাব পাঠায় তারা। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পর সামনে অগ্রসর হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নতুন করে আরেকটি প্রস্তাব পাঠায় এক্সন মবিল।

তেল-গ্যাস উত্তোলনে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তিও (পিএসসি) সংশোধন করেছে সরকার। এতে অনুসন্ধানে পাওয়া গ্যাসের দাম আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহে সংশোধিত পিএসসি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধের পর বঙ্গোপসাগরকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক আছে ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক আছে ১৫টি। এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লক একসঙ্গে ইজারা পেতে চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালের পর দফায় দফায় পেট্রোবাংলা চেষ্টা করছে সমুদ্রের ব্লকগুলো ইজারা দিতে। তবে তাতে সাড়া মেলেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি পসকো দাইয়ু ইন্টারন্যাশনাল বঙ্গোপসাগরের একটি ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেও পরে পেট্রোবাংলার সঙ্গে মতবিরোধে তা ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস ও নরওয়েভিত্তিক স্ট্যাটঅয়েল যৌথভাবে সাগরে কয়েকটি ব্লকে অনুসন্ধানের কাজ পেয়েছিল; কিন্তু লাভজনক মনে না হওয়ায় তারা পিএসসি সই হওয়ার আগেই চলে যায়। শুধু ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) সমুদ্রের একটি ব্লকে কাজ করছে।

এক্সন মবিলকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা কোম্পানি বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, গভীর সমুদ্রে কাজ করার বিষয়ে তারা খুবই দক্ষ। বর্তমানে দেশে যে জ্বালানিসংকট চলছে, সেটা আগামী দিনে আরও বাড়বে। এসব কারণে এক্সন মবিলের প্রস্তাব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, এক্সন মবিলের মতো বড় প্রতিষ্ঠান বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানে কাজ শুরু করলে বিশ্বের অন্য বড় প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক হোসেন মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, মার্কিন কোম্পানি এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে অত্যন্ত দক্ষ এবং পৃথিবীর সেরা প্রতিষ্ঠান। সত্যি যদি এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসে, তবে অবশ্যই তাদের প্রস্তাবকে সরকারের বিবেচনা করা উচিত। তবে বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আছে। গভীর সমুদ্র ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূরাজনীতি কী হতে পারে সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে।

এক্সন মবিলের প্রস্তাব এবং গভীর সমুদ্রে তেল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচলক বিডি রহমত উল্ল্যা আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৪ সালে সমুদ্র বিরোধ মেটার পর প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার তাদের সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধান করে উত্তোলনও করছে। মিয়ানমার থেকে গ্যাস উত্তোলন করে চীন নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ১২ নম্বর ব্লকসংলগ্ন ১১ নম্বর ব্লক থেকে মিয়ানমার গ্যাস উত্তোলন করছে। অথচ বাংলাদেশ এতদিনেও সেখানে কিছু করতে পারেনি। ভৌগোলিকভাবে সীমানা নির্ধারণ হলেও যখন একটি ব্লক থেকে তেল গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় তখন পাশের ব্লক থেকেও গ্যাস চলে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।

তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে সংশ্লিষ্টরা এমনভাবে পিএসসি তৈরি করেছে যাতে কোনো বিদেশি কোম্পানি এলেও কাজ করতে না পারে। এক্সন মবিলের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, সামনে নির্বাচন। এখন মার্কিন কোম্পানির প্রস্তাব। এসব প্রস্তাবনা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]