বেনাপোল-যশোর-ভাঙ্গা মহাসড়কটি ছয় লেন করতে যাচ্ছে সরকার। একশ’ ২৯
কিলোমিটারের এই মহাসড়কটি নির্মাণ করতে প্রাথমিক ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে
প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। সড়কটি নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে প্রকল্পের
প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ। পরিকল্পনা কমিশন
থেকে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দিলে
দৃশ্যমান কাজ শুরু হবে। এই মহাসড়কটি নির্মাণ করা হলে দেশের
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হবে। একই সঙ্গে সাতক্ষীরার
ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে
আরও গতিশীলতা আসবে।
ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বন্দর থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ
আরও বৃদ্ধি পাবে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে এক বিশাল ভূমিকা রাখবে। অভিজ্ঞ মহল
বলছেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলেও সড়কটি নির্মাণ না করায় ভোমরা ও
বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহারকারীরা তেমন একটা সুফল পাচ্ছেন না। ফলে এই দুটি
স্থলবন্দর দিয়ে সড়কটি নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন,
‘বেনাপোল, যশোর হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত সড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার জন্য সরকার
উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এরই মধ্যে একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করেছে সরকার। তারা শুধু সড়ক
নির্মাণে ১১ হাজার ৭২ কোটি টাকার ব্যয় ধরেছে। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণে আরও চার
হাজার ২৩৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই সড়কটি নির্মাণে
প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে প্রকল্পটি শীঘ্রই
একনেক সভায় পাস হবে।’ এরপরই শুরু হবে সড়কের নির্মাণ কাজ।
জানা গেছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, নগরকান্দা, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর, কাশিয়ানী,
নড়াইলের লোহাগড়া, নড়াইল সদর, যশোরের বাঘারপাড়া, যশোর সদর, ঝিকরগাছা ও
শার্শা উপজেলায় জমি অধিগ্রহণ করা হবে। ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ছয় লেনে
উন্নীত করতে সহায়ক প্রকল্প হিসেবে সড়কের দুই পাশে প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ
এবং ইউটিলিটি স্থানান্তরের কাজ সম্পন্ন করা হবে। সওজ সূত্র জানায়,
ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল সড়ক এক হাজার সাতশ’ ৬১ কিলোমিটার বিশিষ্ট এশিয়ান
হাইওয়ের (এএইচ) অংশ। এশিয়ান হাইওয়ে এএইচ-১ এবং এএইচ-২ রুট দুটি বাংলাদেশের
ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। এএইচ-১ তামাবিল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে
সিলেট-ঢাকা-পদ্মা সেতু-যশোর-বেনাপোল দিয়ে অতিক্রম করেছে।
এছাড়া সড়কটি মোংলা বন্দরে যাতায়াতেও ব্যবহৃত হয়। ১২৯ দশমিক ১৭ কিলোমিটার
সড়কটি ছয় লেনে নির্মিত হলে বেনাপোল হয়ে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বছরে
১৫-২০ শতাংশ বাড়বে। প্রকল্পে ১২৯ দশমিক ১৭ কিলোমিটার সড়ক উভয় পাশে সার্ভিস
লেনসহ ছয় লেনে উন্নীত করা হবে। এজন্য এক দশমিক ৯২ লাখ ঘনমিটার সড়ক বাঁধে
মাটির কাজ ও আট হাজার ৬৯২ দশমিক ১৬ মিটার স্ট্রাকচার নির্মাণ করা হবে। এর
মধ্যে থাকবে ফ্লাইওভার, ওভারপাস, ব্রিজ, ফুটওভার ব্রিজ, কালভার্ট ও
আন্ডারপাস। একই সঙ্গে এক হাজার ২৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সাইট ফ্যাসিলিটিজের
কাজ করা হবে। প্রকল্পে পরামর্শক সেবা ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৫৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বপ্নের পদ্মা ও মধুমতি সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।
তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেনাপোল-যশোর-ভাঙ্গার একশ’ ২৯ কিলোমিটার সংকীর্ণ
সড়কটি। সড়কটি আঁকাবাঁকা ও সংকীর্ণ হওয়ার কারণে এই সড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার
হচ্ছে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক ও পরিবহন। ফলে প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি
হচ্ছে। ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনাও। এতে আতঙ্কে রয়েছে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি
গাড়ির চালক ও শ্রমিকেরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত হলে
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরসহ ভারতের কোলকাতার যোগাযোগ অনেক সহজ
হয়ে যাবে। এতে করে রাজধানীর সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দরের দূরত্ব কমবে ৮৬
কিলোমিটার। অন্যদিকে নোয়াপাড়া-বেনাপোল-ভোমরা বন্দরসহ খুলনা বিভাগের ১০
জেলার যানবাহন ও পণ্য পরিবহন যাবে নড়াইলের ওপর দিয়ে। এতে করে সাশ্রয় হবে
সময় ও অর্থ।
এ প্রসঙ্গে, বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক
সম্পাদক, সুলতান মাহমুদ বিপুল বলেন, বেনাপোল ও ভোমরা স্থলবন্দর থেকে
প্রতিদিন কয়েকশ’ পণ্যবাহী ট্রাক এই সড়ক দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে যায়। তবে এই সড়কটি বর্তমানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সংকীর্ণ। সড়কটি
প্রশস্ত না হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাক ও যানবহন চলাচলে মারাত্মক অসুবিধা হচ্ছে।
ফলে সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহারকারী একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিবেশী দেশ
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বাণিজ্য হয় তার ৮০ ভাগই সম্পন্ন হয় বেনাপোল
স্থলবন্দরের মাধ্যমে। তবে স্বপ্নের পদ্মা ও মধুমতি সেতু চালু হওয়ার পর
বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীরা এখনো পর্যন্ত পুরাপুরি সুফল পাননি এই সড়কটি
নির্মাণ না করার কারণে। সড়কটি ছয় লেনে উন্নতি করা হলে ভারতের সঙ্গে আমদানি ও
রপ্তানি বাণিজ্য আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. আবদুল হাকিম
জনকণ্ঠকে জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বেনাপোলের সঙ্গে সারাদেশের
যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে।
সে কারণে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যও বৃদ্ধি
পেয়েছে। তবে বেনাপোল-যশোর-ভাঙ্গা সড়কটি সংকীর্ণ হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাক
চলাচলে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি। আমদানি-রপ্তানি ও রাজস্ব
বাড়াতে এই সড়কটি ছয় লেনে উন্নতি করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা বাস্তবায়ন হলে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক
সমৃদ্ধি আরও বৃদ্ধি পাবে।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঢাকার নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়েজ উদ্দিন
আহমেদ জানিয়েছেন, বেনাপোল-যশোর-ভাঙ্গা সড়কটি নির্মাণের জন্য জমির পরিমাপ
সীমানা এমনকি ছয় লেন রাস্তার ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়েছে। এশিয়ান ইকোনোমিক
ইনভেস্টর ও ভারত দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা এই প্রকল্পের কাজে অর্থ বরাদ্দের
জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
দিবেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, এই ছয় লেনের রাস্তার ব্যস্ততম জায়গায় ওভার
ব্রিজ, রেললাইন ও স্টেশন এলাকায় ফ্লাইওভার করা হবে। বড় বড় আরও কয়েকটি ব্রিজ
করা হতে পারে। সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটি
সরকারের একটি জনবান্ধব মহাউদ্যোগ। যা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এগোচ্ছে।
পদ্মা সেতুর পর এই সড়কটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের জন্য এটিই হবে আরও
একটি মাইলফলক কাজ।