তাঁরা বলেছেন, সামর্থ্যবানদের জন্য তা পরিত্যাগ করা মাকরুহ ও অত্যন্ত অপছন্দনীয়। তদ্রুপ কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার প্রবক্তারাও বলেননি, তা জাকাতের মতো অকাট্য ফরজ বিধান। বরং তাঁরা বলেছেন যে কোরবানি ফরজ স্তরের নিচে এবং সুন্নতে মুয়াক্কাদা স্তর থেকে কিছুটা ওপরে।
কোরআনের আলোকে কোরবানি
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ (সুরা কাউসার, আয়াত : ২)
উক্ত আয়াতে নির্দেশ হয়েছে, আপনি ‘নাহর’ তথা কোরবানি করুন আপনার প্রতিপালকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে।
এই নির্দেশের মাধ্যমে কোরবানি করা ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। প্রখ্যাত মুফাসসির তাবারি ও ইবনে কাসির (রহ.) লেখেন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-সহ বহু তাবেঈনের বক্তব্য অনুসারে আয়াতে কোরবানির নির্দেশ করা হয়েছে। (তাবারি : ২৪/৬৫৫; ইবনে কাসির ৮/৫০৩)
উক্ত আয়াতে ‘ওয়ানহার’ শব্দটি আরবি ব্যাকরণমতে নির্দেশসূচক, যা নির্ভরযোগ্য মতানুসারে সাধারণত ফরজ-ওয়াজিবের অর্থবাহী, যদি ভিন্ন উদ্দেশ্য শক্তিশালী হওয়ার প্রমাণ না থাকে। এই নীতি অনুসারে এর দ্বারা কোরবানি ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। (আহকামুল কোরআন : ৫/৮৬)
হাদিসের আলোকে কোরবানি
অসংখ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানির নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। যেমন—
১. রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২৩)
হাদিসটিকে হাকিম, জাহাবি, আইনি ও ইবনে হজর (রহ.) প্রমুখ মুহাদ্দিসরা সহিহ বলেছেন। এতে কোরবানি ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। অন্যথায় কোরবানি পরিত্যাগকারীর জন্য এমন কঠিন ধমকি আসত না।
২. একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ঈদের নামাজ পড়ানোর সময় কিছু লোক নামাজের পূর্বেই কোরবানি করে ফেলে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিলেন, ‘যারা নামাজের আগে কোরবানি করেছে তাদের অবশ্যই পুনরায় কোরবানি করতে হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৬৪)
যদি কোরবানি ওয়াজিব না হতো, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.) পুনরায় কোরবানির নির্দেশ দিতেন না। তাঁর পুনরায় নির্দেশ দেওয়াটা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণবাহী। এ মর্মে জুনদুব বাজালি (রা.) ও বারা (রা.)-সহ একাধিক সাহাবি থেকে আরো বর্ণনাও পাওয়া যায়। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৫০০, মুসলিম, হাদিস : ১৯৬০)
৩. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থানকালে প্রতিবছরই কোরবানি করতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
ইমাম তিরমিজি (রহ.) হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। শরিয়তের মূলনীতি হচ্ছে যে কাজ রাসুলুল্লাহ (সা.) নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিকভাবে করেছেন, তা ওয়াজিব।
৪. ইবনে ওমর (রা.)-কে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, কোরবানি কি ওয়াজিব? তিনি উত্তরে বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানি করেছেন এবং মুসলমানরাও কোরবানি করেছেন।’ প্রশ্নকারী বারবার জিজ্ঞাসা করলে ইবনে ওমর (রা.) একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৬)
আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.)-এর উত্তরে কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার বার্তা পাওয়া যায়। কেননা যদি কোরবানি ওয়াজিব না-ই হতো, তবে তিনি স্পষ্টভাবে বলতেন ‘ওয়াজিব নয়’। তিনি তা না করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও মুসলিমগণের আমলের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করেছেন, যা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৩/৫৪৯)
৫. একদা আরাফার ময়দানে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে মানুষ সকল, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের ওপর প্রতিবছর কোরবানি করা আবশ্যক এবং আতিরাও (রজব মাসে পশু জবাই করা)।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৮৮)
ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, আতিরার বিষয়টি রহিত হয়ে গেছে। তিরমিজি (রহ.) হাদিসটি ‘হাসান’ বলেছেন। ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, হাদিসটি সূত্রের বিচারে শক্তিশালী। (ফাতহুল বারি ৪/১০)
সারকথা, কোরবানি কোরআন-সুন্নাহের বহু দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধমতে ওয়াজিব তথা আবশ্যকীয় একটি আমল এবং তা ইসলামের নিদর্শন। এটাই বিশ্ব মুসলিমের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক কর্মপন্থা। তবে তা কেবল সামর্থ্যবান মুকিম ও বালেগ মুসলমানের ওপর আবশ্যক। তাই মুসলিম সমাজে তা নিয়ে নতুন করে সন্দেহের বীজ বপন করা ও বিভ্রান্তি ছড়ানো নিতান্তই গর্হিত কাজ। আল্লাহ আমাদের হিদায়াতের ওপর অটল রাখুন। আমিন