পতেঙ্গা-আনোয়ারা সংযুক্তি তিন মাস পরেই


অনলাইন ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 29-05-2023

পতেঙ্গা-আনোয়ারা সংযুক্তি তিন মাস পরেই

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার আভাস দিয়েছিল সেতু কর্তৃপক্ষ। পরিকল্পনা অনুযায়ী এপ্রিলে দেশের প্রথম নদীর তলদেশের সড়কপথের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সুড়ঙ্গপথের দুই দিকে ‘স্ক্যানার’ স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়, যা প্রকল্পের মূল নকশায় ছিল না। মূলত নাশকতা প্রতিরোধ করতেই স্ক্যানার স্থাপনের চিন্তা করা হয়েছে।

এতে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। সঙ্গে বাড়ে খরচ। এরই মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৯৭.২ শতাংশ। আর টানেলের সাড়ে ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

 

অবকাঠামোগত নির্মাণকাজও প্রায় শেষ হয়ে গেছে, চলছে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। দুই টিউবেই একসঙ্গে চলছে বাতাস নির্গমনব্যবস্থা সচল রাখা, অগ্নিনির্বাপণ, পানি নিষ্কাশনে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, কমিউনিকেশন ও মনিটরিং ব্যবস্থাপনা পরীক্ষার কাজ।

সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন জানান, সব কাজ গুছিয়ে আনা হচ্ছে। টানেলের ভেতর দুই ধরনের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে।

সেগুলোও শেষ পর্যায়ে।

 

দ্রুতই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।

সেতু বিভাগের সূত্র বলছে, আর মাত্র তিন মাস। খুলতে যাচ্ছে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ। সব ঠিক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

যান চলাচলের জন্য টানেল খুলে দেওয়া হলে চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীর দুই পার যুক্ত হবে ভিন্নরূপে। নদীর ওপরে পানির ঢেউ আর তলদেশে চলবে যান। এই টানেল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা এলাকাকে যুক্ত করেছে। এটি উদ্বোধনের পর অল্প সময়েই কর্ণফুলী নদী পার হতে পারবে এই অঞ্চলের মানুষজন। এতে বাঁচবে সময়, বাড়বে অর্থনৈতিক চাকার গতি।

টানেলে দুটি টিউব রয়েছে। দক্ষিণ পাশের টিউব দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী যান চলাচল করবে। ঠিক পাশের উত্তর টিউবটি দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী যান চলাচল করবে।

এদিকে মূল নকশার বাইরে স্ক্রিনিং মেশিন যুক্ত করা প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, সব গাড়িকেই এই মেশিন অতিক্রম করে টানেলের ভেতর যেতে হবে। নিরাপত্তা বিবেচনায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, মেশিন কোথায় বসানো হবে সেটি এখনই বলব না। তবে এটি টানেলের প্রবেশমুখ থেকে নিশ্চয়ই কিছুটা দূরে স্থাপন করা হবে। যেন গাড়ি চলাচলে অসুবিধা না হয় সেই দিকটিও খেয়াল রাখা হবে।

টানেলের পথ কত দূর : টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। টানেলের এই অংশ নদীর তলদেশে অবস্থিত। টিউবের ভেতরের ব্যাস ১০.৮০ মিটার। আর টিউবসহ মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এই দুই টিউব তিনটি সংযোগপথের মাধ্যমে যুক্ত হয়েছে। আপৎকালে এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে ০.৫৫ কিলোমিটার ও আনোয়ারা প্রান্তে ৪.৮ কিলোমিটারসহ মোট ৫.৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে।

এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়ালসড়ক (ভায়াডাক্ট) রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ৯.৩৯ কিলোমিটার নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। ৩.৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলটি কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছে পশ্চিম প্রান্তে পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) এবং কর্ণফুলী সার কারখানার (কাফকো) মাঝখান দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছেছে।

সংযোগ উড়ালসড়ক ও সংযোগ সড়কের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। দুই প্রান্তে বসেছে টোল প্লাজা। আনোয়ারা প্রান্তে সড়কের দৈর্ঘ্য ও টোল প্লাজার সংখ্যা বেশি।

টানেলের ভেতর দেখতে কেমন : টানেলের ভেতর একমুখী গাড়ি চলাচলের জন্য দুই লেনের সড়ক তৈরি করা হয়েছে। সড়কপথে কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়নি। একটু ঢেউ ঢেউ রাখা হয়েছে। আবার সড়কের দুই পাশে হাঁটার জায়গা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে সেখানে দাঁড়ানো এবং হাঁটা যাবে। টানেলের ভেতর দুই পাশে ফাইবার বোর্ড লাগানো হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা দেয়ালের মতো। এই ফাইবার বোর্ড আগুনপ্রতিরোধক।

টানেলের ভেতরের ছাদেও কালো রঙের আগুনপ্রতিরোধক ফাইবার বোর্ড লাগানো হয়েছে। ভেতরে হাঁটার জন্য যে জায়গা রাখা হয়েছে, সেই পথে কিছুটা দূরে দূরে জরুরি বের হওয়ার পথ রয়েছে। এই পথে টানেলের এক টিউব থেকে অন্য টিউবে যাওয়া যাবে। মাথার ওপর কিছুটা দূরে দূরে বাতাস নির্গমনের জন্য ফ্যান লাগানো আছে। সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে বাতি।

শুরুটা ২০১৬ সালে : নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী টানেলের প্রথম টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। পরের বছর ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে।

এই প্রকল্পে অর্থায়ন বাবদ চীনের এক্সিম ব্যাংক পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বাকি টাকার জোগান দেয় বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। টানেলের নির্মাণকাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কম্পানি।

শুরুতেই দিনে চলবে ১৭ হাজার গাড়ি : এই পথে কত যান চলবে তা বুঝতে ২০১৩ সালে একটি সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, টানেল চালুর বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

যেসব যান টানেলে চলতে পারবে না : বঙ্গবন্ধু টানেলে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সেতু বিভাগ। মোটরসাইকেল যেন চলাচলের অনুমতি না পায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেতু বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র কালের কণ্ঠকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সূত্র বলছে, টানেলে কোথাও থামার সুযোগ নেই। দুই লেনেই দ্রুতগতিতে যান চলাচল করবে। মোটরসাইকেল একটি ঝুঁকিপূর্ণ যান। এ কারণে দুর্ঘটনা বেশি হয়। তাই টানেলে যেন মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হয়, সে জন্য একটি প্রস্তাব তোলা হয়েছে। এ ছাড়া দাহ্য পদার্থবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও তিন চাকার যানও টানেলে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

এমন সিদ্ধান্তের পক্ষেই নিজের ভাবনা ব্যক্ত করেছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, টানেলে সব যান খুব দ্রুতগতিতে যাবে। মোটরসাইকেল কখনোই দূরপাল্লার বাহন হতে পারে না। তাই এখানে মোটরসাইকেল না চালানোই ভালো। আবার মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য আলাদা লেন থাকা দরকার। যেহেতু টানেল খুব বেশি প্রশস্ত নয়, তাই এখানে আলাদা লেন করা যাবে না।

কোন যানে কত টোল : টোল নির্ধারণ কমিটি সূত্রে জানা যায়, টানেলে কার ও জিপজাতীয় যান, পিকআপ, মাইক্রোবাস, ছোট বাস (৩১ আসন বা এর কম), মাঝারি বাস (৩২ আসন বা এর বেশি), বড় বাস (তিন এক্সেল), ছোট ট্রাক (পাঁচ টন পর্যন্ত), মাঝারি ট্রাক (পাঁচ টনের বেশি থেকে আট টন পর্যন্ত), মাঝারি ট্রাক (আট টনের বেশি থেকে ১১ টন পর্যন্ত), ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত), ট্রেইলার (চার এক্সেল পর্যন্ত)—এসব যান চলাচল করবে। এমন বিভাজন করেই টোল নির্ধারণ করা হচ্ছে।

সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত টোল হার হলো : কার ও জিপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাসে ২৫০ টাকা, পিকআপ ২০০ টাকা, ছোট বাস ৩০০ টাকা, মাঝারি বাস ৪০০ টাকা, ছোট ট্রাক ৪০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ৫০০ টাকা, ট্রাক ৬০০ টাকা, তিন এক্সেল পর্যন্ত ট্রাকে টোল দিতে হবে ৮০০ টাকা, চার এক্সেল পর্যন্ত ট্রেইলারকে এক হাজার টাকা এবং চার এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য ২০০ টাকা করে বাড়তি টোল দিতে হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক মনে করেন, টানেল যোগাযোগব্যবস্থা সহজ করবে। দূরত্ব বিবেচনায় টোল কিছুটা বেশি। কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেশি। এখানে আলো-বাতাসের জন্যও পয়সা খরচ হবে। সেটা অন্য সেতুতে হয় না। তাই টোল কিছুটা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]