গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজয়ের পর দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা গাজীপুরে তৃণমূলের কমিটিগুলো গুছিয়ে ফেলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে যাঁরা নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন তাঁরা সাংগঠনিক শাস্তির মুখে পড়তে পারেন বলেও জানা গেছে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৩১ মে থেকে মহানগরের থানাগুলোতে নির্বাচন পর্যালোচনাসভা শুরু হবে।
সেখানেই ওয়ার্ডগুলোতে কাদের কী ভূমিকা ছিল, তা অভিযোগ আকারে উঠে আসবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, গাজীপুরের হারকে দলের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। এই হারের ফলে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি নতুন করে ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। কোন্দল নিরসন করতে না পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে চিন্তিত ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়।
গতকাল রবিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যান গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত আজমত উল্লা খান। তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিও।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গাজীপুরে নৌকার পরাজয়ে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি নির্বাচনে কোন সংসদ সদস্যের এলাকায় নৌকা কত ভোট পেয়েছে, তা জানতে চান আজমত উল্লার কাছে।
আজমত উল্লা খান দলীয় প্রধানকে সেই তথ্য দেন।
আজমত উল্লা শেখ হাসিনাকে জানান, তিনি বাসন থানার ৪২টি কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে প্রথম হয়েছেন। বাকি ৪১টিতেই দ্বিতীয় হয়েছেন। কোনাবাড়ী থানার ৪২ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪০টিতে প্রথম হয়েছেন। কাশিমপুর থানার ৪৭ ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২টিতে প্রথম হয়েছেন।
এই তিনটি থানা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নির্বাচনী এলাকা।
সদর থানার ৯৬ ভোটকেন্দ্রের ৭৪টিতে নৌকা পরাজিত হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ ফল করেছেন গাছা থানার ওয়ার্ডগুলোতে। এখানে ৫৭ ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র দুটিতে জিতেছেন আজমত উল্লা। এই থানায় প্রায় ১৫ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন বিজয়ী জায়েদা খাতুন। নির্বাচনে আজমত উল্লা ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটে পরাজিত হন। এই দুটি থানা যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের নির্বাচনী এলাকা।
পুবাইল থানার ৩২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২১টিতে নৌকা পরাজিত হয়েছে। এ থানাটি সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির নির্বাচনী এলাকা।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আজমত উল্লা খানকে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘শান্ত হও, মনে দুঃখ নিয়ো না। তুমি সৎ মানুষ। ভালো সংগঠক। এখন গাজীপুরে গিয়ে তৃণমূলের সংগঠন গোছানোয় মনোযোগ দাও। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি করো। সব এলাকায় গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করো। যারা ভোট দিয়েছে বা দেয়নি—সবার সঙ্গেই কথা বলো।’
আজমত উল্লা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনে পরাজয়ের সব তথ্যই উনার (শেখ হাসিনা) কাছে আছে। উনি আমাকে কিছু সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সংগঠন কিভাবে শক্তিশালী করা যায় সে বিষয়ে বলেছেন।’ তিনি বলেন, ‘দলীয় সভাপতি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন কোন মন্ত্রী, এমপির এলাকায় নৌকা কত ভোট পেয়েছে। আমি আমার কাছে যা তথ্য ছিল তা উনাকে জানিয়েছি।’
আজমত উল্লা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের ভেতরে যেসব বিশ্বাসঘাতক ছিল, যারা নৌকার বিরুদ্ধে গেছে, তাদের বিরুদ্ধে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেবে। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমার কাজ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা। তবে দলের ভেতরে একটা শুদ্ধি অভিযান হওয়া উচিত। কারণ একবার যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে তারা বারবার করবে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গতকাল রাত ৮টার দিকে টঙ্গীতে আজমত উল্লা খানের বাসভবনে গাজীপুরের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বৈঠকে বসেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ একাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে নেতারা গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা করেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, গাজীপুরের যেসব ওয়ার্ড কমিটির নেতারা নৌকার পক্ষে কাজ করেননি তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তির কথা ভাবা হচ্ছে। কয়েকটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। আগামী দিনে পূর্ণাঙ্গ ওয়ার্ড কমিটি কিংবা মহানগর কমিটিতে নৌকার বিরোধিতাকারীদের রাখা হবে না।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে দলের বিপক্ষে যদি কেউ নির্বাচন করে, তাহলে সে বহিষ্কার হয়ে যাবে। আর যদি কেউ দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ডে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। এর জবাব সন্তোষজনক না হলে অব্যাহতি দিয়ে তা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ আকারে পাঠানো হবে।
সূত্র জানায়, গত রাতে আজমত উল্লা খানের বাসভবনের বৈঠকে নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে আগামী ৩১ মে থেকে নির্বাচনী পর্যালোচনাসভা শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। গাজীপুরের ৯টি থানায় পর্যায়ক্রমে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। ৩১ মে সকাল ১০টায় কাশিমপুর, বিকেল ৩টায় কোনাবাড়ী ও ২ মে বাসন থানায় পর্যালোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা, স্থানীয় সংসদ সদস্য, থানা আওয়ামী লীগ, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও যাঁরা দলের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন এবং নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্র কমিটিতে কাজ করেছেন, তাঁরা উপস্থিত থাকবেন। সভায় নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ, দলের নেতাকর্মীদের ভূমিকাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হবে।
জানতে চাইলে আজমত উল্লা খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ৯টি থানা যেসব সংসদীয় নির্বাচনী এলাকায় পড়েছে, নির্বাচন-পরবর্তী পর্যালোচনাসভায় সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সব থানায় এ সভা আয়োজন করা হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানে কিছু অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন তো নৌকার বিরুদ্ধে ভোট দেবেই; কিন্তু দলের লোকজন কেন নৌকায় ভোট দেবে না? গাজীপুরের হারের বিষয় খতিয়ে দেখতে একটা উপকমিটি গঠন হতে পারে বলে জানা তিনি।
ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা গাজীপুরের হারের বিষয়টি চুলচেরা বিশ্লেষণ করব। আমাদের কিছু লোক তো দলের সঙ্গে বেঈমানি করেছে। এগুলোর সঙ্গে কারা আছে, নেতাদের মধ্যে কেউ এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন কি না—আমরা তা খতিয়ে দেখব। এখনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এখানকার অভিজ্ঞতাগুলোকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে কাজে লাগাব। এটা আমাদের এক ধরনের সতর্কবার্তা দিল বলে আমরা মনে করি। সমস্যাগুলোকে কিভাবে সমাধান করা যায়, সেটায় গুরুত্ব দেব।’