বিশ্বের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে নামী, সবচেয়ে বিখ্যাত এক বিস্ময়কর মহানগর নিউ ইয়র্ক। হাজারো স্বপ্ন তৈরি হয় এখানে, হাজারো বাস্তব ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা লিখেছিলেন, এই শহর কখনও ঘুমোয় না। আজও এই শহরের ‘সাবওয়ে’ বা মেট্রো কখনও বন্ধ হয় না, সারারাত ধরে ট্রেন ছুটে যায় এ’প্রান্ত থেকে ও’প্রান্ত!
জনসংখ্যায় আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর নিউ ইয়র্ক। এতটাই বড় যে, দ্বিতীয় স্থানে থাকা লস এঞ্জেলসের চাইতে নিউ ইয়র্কের লোকসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। বাণিজ্যে ওয়াল স্ট্রিট, থিয়েটারে ব্রডওয়ে, বিজ্ঞাপনে ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ… সারা পৃথিবীর সংস্কৃতির এত বড় প্রাণকেন্দ্র বোধ হয় আর কোথাও নেই। বলা হয়, ডাবলিনের চেয়ে বেশি আইরিশ, তেল আভিভের চাইতে বেশি ইহুদি ও নেপলসের চাইতে বেশি ইতালীয় থাকেন এই নিউ ইয়র্কে।
কখনও ঘুমোয় না নিউ ইয়র্ক, বলেছিলেন সিনাত্রা।
নিউ ইয়র্ক নামটার সঙ্গেই যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ‘স্কাইস্ক্র্যাপার’ শব্দটা। যে কোনও হলিউডি ছবিতে নিউ ইয়র্কের বিবরণের প্রথম ছবিটাই হয় অতলান্তিকের দাঁড়ানো আকাশছোঁয়া বহুতলের সারি। আজ দুবাই থেকে সাংহাই, টোকিও থেকে সাও পাওলো, গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণে এগিয়ে গিয়েছে অনেকেই। কিন্তু নিউ ইয়র্কের তুলনা নিউ ইয়র্কই। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, সেন্ট্রাল পার্ক টাওয়ার, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ক্রাইজলার বিল্ডিং, নিউ ইয়র্ক টাইমস বিল্ডিং একের পর এক অট্টালিকা মার্কিন আধুনিকতা ও বৈভবকে একেবারে সদম্ভে ঘোষণা করছে।
আর এই দম্ভের ভারে একেবারে বসে যাচ্ছে গোটা শহরটাই।
কতটা ভারি এই শহর? মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সংস্থার এক হিসেব বলছে, প্রায় ৭৭৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়ানো এই নিউ ইয়র্ক শহরের ওপরে রয়েছে ৭৬ কোটি টন ইস্পাত, কংক্রিট ও ইঁট-বালি-সিমেন্টের আস্তরণ। এর সঙ্গে রয়েছে প্রতিটি বাড়িতে থাকা বিপুল আসবাব, রয়েছে তাতে বসবাস করা বা কাজ করা আশি লক্ষ মানুষ, রয়েছে তাঁদের অজস্র গাড়ি, বাস, ট্রাক।
ভারি যে কোনও বস্তুই চাপ সৃষ্টি করে। এই নিউ ইয়র্ক শহরও তেমনি ভূপৃষ্ঠের ওপর তৈরি করেছে এক বিপুল, বিশাল পরিমাণ চাপ। সেটা এতটাই যে, এক সমীক্ষা বলছে, নিউ ইয়র্ক শহর প্রতি বছর প্রায় ১ থেকে ২ মিলিমিটার করে ভেতরে বসে যাচ্ছে!
শহরের মাঝে রয়েছে তার প্রাণকেন্দ্র ম্যানহাটান দ্বীপ।
এটা ঠিক কতটা আশঙ্কার, জানতে গেলে একবার নিউ ইয়র্ক শহরের ভূগোলটা জানতে হবে। অতলান্তিকের তীরে অবস্থিত নিউ ইয়র্ক এমনিতেই সমুদ্রের উপকূলবর্তী শহর। বস্তুত, নিউ ইয়র্ক প্রকৃতপক্ষে হাডসন নদীর মোহনায় থাকা কয়েকটি দ্বীপ ও সন্নিহিত অঞ্চলের সমাহার। মোট তিনটি দ্বীপ ম্যানহাটান, লং আইল্যান্ড এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড এবং মূল ভূখণ্ডের কিছুটা নিয়ে তৈরি পাঁচটি বরোতে বিভক্ত এই শহর। যার মধ্যে একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে ম্যানহাটান দ্বীপ, নিউ ইয়র্কের প্রাণভোমরা। সেন্ট্রাল পার্ক, ওয়াল স্ট্রিট, টাইমস স্কোয়ার, রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দপ্তর, ন্যাসডাক, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনাল স্টেশন সবই রয়েছে এখানেই।
আর এই বিপুল ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপই এখন রয়েছে আশঙ্কার কেন্দ্রে। এতদিন বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তা ছিল। এবার তাতে যোগ হয়েছে কংক্রিটের ভরে শহরের বসে যাওয়া। ফলে সমুদ্রের জলতল সামান্য বাড়া মানেই সরাসরি তা আক্রমণ হানবে নিউ ইয়র্কের দ্বীপগুলোয়। তার ওপর কংক্রিটের চাপে শহর আরো বসে গেলে অচিরেই টাইমস স্কোয়ার চলে যেতে পারে জলের তলায়!
এই কংক্রিটের ভার শুধু নিউ ইয়র্ক নয়, কার্যত গোটা পৃথিবীর নাভিঃশ্বাস তুলে ফেলেছে। সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকার এক প্রবন্ধে ইজরায়েলের ওয়েইজমান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের একদল বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, ২০২০ সালে জীব্জগতে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব হয়ে গিয়েছে। তাঁদের হিসেব বলছে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথমবার মানুষের তৈরি বস্তুসামগ্রীর ভর গোটা জীবজগতের ভর বা ‘বায়োমাস’-কে ছাপিয়ে গিয়েছে!
এবং অতি অবশ্যই, তালিকায় নিউ ইয়র্ক একা নয়।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা, ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা রয়েছে এই তালিকায় একেবারে ওপরে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় শহর, আসিয়ান দেশগুলোর অলিখিত রাজধানী, অন্যতম প্রাচীন ও উন্নত শহর জাকার্তাকে বলা হচ্ছে, বিশ্বের দ্রুততম ডুবতে থাকা মহানগর! জাভা দ্বীপে অবস্থিত জাকার্তা প্রতি বছর প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার করে বসে যাচ্ছে। অস্থির জাভা দ্বীপের খুব নিচু জমিতে গড়ে ওঠা এই শহরের অনেকটা ইতিমধ্যেই সমুদ্রতলের নিচে চলে গিয়েছে। বান্দুং ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির এক বিজ্ঞানীর কথায়, ২০৫০ সালের মধ্যে নাকি উত্তর জাকার্তার ৯৫ শতাংশ এলাকা জলের তলায় চলে যাবে।
পরিস্থিতি এতদূর খারাপ হয়েছে যে, গত ১০ বছরে উত্তর জাকার্তা প্রায় আড়াই মিটার বসে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার সরকার নতুন রাজধানী বানানোর তোড়জোড় করছে, জাভা দ্বীপ থেকে সরিয়ে বোর্নিও দ্বীপে ‘নুসানতারা’ বলে নতুন রাজধানী শহর গড়ে তোলা হচ্ছে।
শুধু জাকার্তা নয়, গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়েই বিভিন্ন উপকূলবর্তী শহর বিজ্ঞানীদের চিন্তা বাড়াচ্ছে। তালিকায় রয়েছে ফিলিপাইনসের রাজধানী ম্যানিলা, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পাকিস্তানের করাচি ও ভারতের মুম্বই।
বস্তুত, শুধু কংক্রিটের ভারটাই শেষ কথা নয়। যে কোনও শহরের বাসিন্দাদের চব্বিশ ঘন্টা পরিশ্রুত পানীয় জলের জোগান দেওয়াটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তার চেয়েও স্বাভাবিক হচ্ছে, তার জন্য পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তোলা। আজকাল সব বাড়িতেই প্রায় একটা করে সাবমার্সিবল পাম্প লাগানো থাকে। কিন্তু এতেই বিপদ বাড়ছে শহরের। এই জল আসে মাটির তলার জলস্তর বা ‘অ্যাকুইফার’ থেকে। মাত্রাতিরিক্ত হারে জল তোলা হলে তখন বৃষ্টিপাতে সেই জলের ঘাটতি মেটে না। ফলে জল কমে এলেই বিপুল চাপে বসে আসতে থাকে মাটি।
ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলনের ফলে তীব্র সংকটে মেক্সিকো সিটি, বসে গিয়েছে তিরিশ ফুট।
এই সমস্যার আদর্শ উদাহরণ মেক্সিকো সিটি। ষোলো শতকে স্পেনীয় কনকিস্তাদোররা মেক্সিকোর সমৃদ্ধ অ্যাজতেক সভ্যতাকে ধ্বংস করে নিজেদের নতুন শহর বানাতে উদ্যোগী হয়েছিল। তখনই দুটো সুবিশাল হ্রদকে কার্যত শুষে নেওয়া হয়েছিল নগরায়ণের নামে। সেই শুরু। এখন লাতিন আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ এই মহানগরে জল তোলার ফলে এমনই অবস্থা হয়েছে যে, আর মিলিমিটার-সেন্টিমিটার নয়, প্রায় ৩০ ফুট বসে গিয়েছে গোটা শহর।