বাংলাদেশ–ভারতের মধ্যে টাকা–রুপিতে বাণিজ্য, ঘোষণা আসছে


অনলাইন ডেস্ক , আপডেট করা হয়েছে : 16-05-2023

বাংলাদেশ–ভারতের মধ্যে টাকা–রুপিতে বাণিজ্য, ঘোষণা আসছে

মার্কিন ডলারের পাশাপাশি বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ও ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু করা এখন সময়ের ব্যাপার। এ জন্য উভয় দেশই রাজি। প্রক্রিয়াও এগোচ্ছে দ্রুতই। আগামী সেপ্টেম্বরে টাকা-রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু করার লক্ষ্যে কাজ করছে দুই দেশ। তবে এর আগেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এমন আভাসই পাওয়া গেছে।

বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রথমে কোভিড ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ডলার-সংকট দেখা দেয়, যা এখনো চলমান। এর ওপর আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এরই মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে বাংলাদেশি টাকা ও তাদের রুপি ব্যবহারের মৌখিক প্রস্তাব দেয়।

তখন দিল্লিতেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে বলা হয়। আর দিল্লি থেকে ফিরে এসে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত কিছু বলতে পারিনি। বলেছি আলোচনা হতে পারে।’ জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। এরপর ভারতকে জানিয়েছে যে এগোনো যেতে পারে।

প্রস্তাবটি কার্যকর হলে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্পন্ন হবে। ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটাকে আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’ বলা হয়।

উদ্যোগটি এবার বাস্তব রূপ দেখতে যাচ্ছে। ভারত অবশ্য ১০ বছর আগে ২০১৩ সালেও একবার বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও রুপিতে বাণিজ্য করার উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে বিষয়টি আর এগোয়নি।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাকা-রুপিতে বাণিজ্য করা নিয়ে এখন কাজ করছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানতে পেরেছি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি ভারতের বেঙ্গালুরুতে জি-২০ সম্মেলনের এক ফাঁকে দুই দেশের গভর্নরদেরও বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। আগামী জুনে না হলেও সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে টাকা-রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া উদ্বোধনের কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, কাজটি হচ্ছে এবং দ্রুত গতিতেই প্রক্রিয়া এগোচ্ছে। দুই পক্ষ প্রস্তুত থাকলে ছোট একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর উদ্বোধন হবে। এটি কতটুকু জনপ্রিয়তা পাবে, না-পাবে, সেটি পরের বিষয়। তবে এটি হচ্ছে।

রাশিয়া, চীন, ভারত—সবাই আস্তে আস্তে ডলার থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা করছে। আমাদেরও ডলারের বিকল্প ভাবতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানির সমান অর্থ রুপি দিয়েও শুরু করা যায়, খারাপ কী? আমি উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাচ্ছি।

তাসকিন আহমেদ, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।

কবে হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে মেজবাউল হক বলেন, ‘প্রথমে আগামী সেপ্টেম্বর ধরে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। এখন মনে হচ্ছে, জুন-জুলাইয়ের দিকেও হয়ে যেতে পারে।’

জানা গেছে, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ইতিমধ্যে ভারতীয় মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিদ্যমান আইনি বাধা দূর করেছে। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ও বাণিজ্য সংগঠন ও ব্যাংকগুলোকে রুপিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার পরামর্শ দেয়। ইতিমধ্যে মরিশাস, ইরান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু করেছে ভারত। তারা আন্তর্জাতিক বাজারে রুপির কদর বাড়াতে চায়। এ জন্য শুধু বাংলাদেশ নয়, রাশিয়াসহ অন্য অনেক দেশের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছে দেশটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী আপাতত দুই দেশের দুটি করে চারটি ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন চালু হবে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের সোনালী ও ইস্টার্ণ ব্যাংক এবং ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ও আইসিআইসিআই ব্যাংক পারস্পরিক হিসাব খোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এর অংশ হিসেবে গত মাসে আরবিআই ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসে সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম ও ইস্টার্ণ ব্যাংকের এমডি আলী রেজা ইফতেখারের সঙ্গে বৈঠক করে গেছে।

ঝুঁকির আশঙ্কা আছে, নাকি নেই

বিশ্লেষকদের মতে, রুপি বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত নয়। তার ওপর এটি হলে একপক্ষীয় মুদ্রা বা রুপিভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় উপনীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে রয়েছে। তাই রুপিতে লেনদেনে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। কারণ, প্রক্রিয়াটি শুরু হলে শুধু পণ্য বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, সেই সঙ্গে ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়বে।

ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করেন এমন একজন ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ভারতের ব্যাংক থেকে রুপি ঋণ নিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো পরিস্থিতি যেন না হয়। সেটি হলে সুদ ব্যয়ের বোঝা বাড়বে। আবার ভারত যখন-তখন বাংলাদেশি মুদ্রার বিপরীতে রুপির দর বাড়িয়ে দেবে এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে সেবার।

বাংলাদেশ-ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি ও ইফাদ গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান তাসকিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনকার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশও দূরে নয়। রাশিয়া, চীন, ভারত—সবাই আস্তে আস্তে ডলার থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা করছে। আমাদেরও ডলারের বিকল্প ভাবতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের ২০০ কোটি ডলারের রপ্তানির সমান অর্থ রুপি দিয়েও শুরু করা যায়, খারাপ কী? আমি উদ্যোগটিকে স্বাগত জানাচ্ছি।’

তাসকিন আহমেদ আরও বলেন, ভারতের সঙ্গে টাকা-রুপিতে বাণিজ্য করতে হলে অবশ্যই খাদ্যপণ্যসহ অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]