মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলেও অর্থনীতিতে সংকটের কারণে আপাতত সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো বা পে স্কেল দেওয়ার পরিকল্পনা
নেই। তবে তাঁদের কিছুটা স্বস্তি দিতে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২০
শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। আগামীকাল বুধবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আগামী অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত করার বৈঠকে
এ বিষয়ে প্রস্তাব উঠছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে আগামী
অর্থবছরের জন্য আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনা উপস্থাপন করার কথা।
সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা। সর্বশেষ
২০১৫ সালের জুলাই মাসে অষ্টম স্কেল কার্যকর হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর
জুলাইয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন।
অবশ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ইনক্রিমেন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল বেতন
কমিশনের। এ জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও করা হয়।
কিন্তু ইনক্রিমেন্ট ৫ শতাংশই রয়ে গেছে।
সর্বশেষ বেতন স্কেল দেওয়ার আট বছর কেটে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের
কারণে খাদ্যপণ্যসহ পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সরকারি চাকরিজীবীদের বিভিন্ন
সংগঠন নতুন পে স্কেলের দাবি তুলছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)
সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী গেল এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৩
শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের খসড়া
চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে মহার্ঘ ভাতা খাতে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। বাজেট
চূড়ান্তকরণ-সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আগামীকালের বৈঠকে এ বিষয়ে
সিদ্ধান্ত আসতে পারে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রী
এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান,
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর
রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনসহ প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত থাকার
কথা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪
লাখ। তবে বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন খাতে ব্যয় সাশ্রয় পদক্ষেপ গ্রহণ
করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ ১
হাজার ৯৩ কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত বাজেটে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা রাখা
হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ৭৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের খসড়া
প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ। মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে এ অঙ্ক বাড়বে।
মূল্যস্ফীতির চাপ ও বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটানোর বাড়তি ব্যয় মাথায় রেখে
আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ের খসড়া করেছে অর্থ
মন্ত্রণালয়; যা আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত মোট দেশজ উৎপাদনের
(জিডিপি) ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার
৬৪ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়।
ভর্তুকিতে সম্ভাব্য বরাদ্দ ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণের জন্য সার, বিদ্যুৎ ও
গ্যাসের দাম কয়েক দফা বাড়ানোর পরও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২৩-২৪
অর্থবছরে এসব খাতে ভর্তুকি বাবদ বাড়তি বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি
অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকির দায় মেটাতে নতুন অর্থবছরের বরাদ্দের একটি অংশ
ব্যয় হবে। তবে চলতি অর্থবছরের বকেয়া বাদ দিলে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকির
পরিমাণ কম হবে। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগে সম্মতি দিয়েছে
সম্প্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া আইএমএফ মিশন।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ ঋণ খাতে ৮২ হাজার ৭৪৫
কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১
লাখ ২ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এসব খাতে মোট
বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হতে পারে।
বিদ্যুতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে
ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ এ খাতে
অতিরিক্ত সাড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দাবি করার পর এই অর্থবছরে তিন
দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপরও সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে
ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। জানা গেছে,
জুনের মধ্যে আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে চলতি
অর্থবছরের ভর্তুকির একটি অংশ পরিশোধের জন্য নতুন বাজেটে এ খাতে প্রায় ৩৩
হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে।
কৃষি ও খাদ্যে সম্ভাব্য ভর্তুকি
গত অর্থবছরের বাজেটে কৃষি ভর্তুকিতে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
কিন্তু সারের দাম বাড়ায় গত অর্থবছর ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন
হয়। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ১৫ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা
বরাদ্দ রাখা হয়। ফলে কৃষি ভর্তুকি পরিশোধে ঘাটতি থেকে যায়। চলতি অর্থবছর এ
খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের
অতিরিক্ত ভর্তুকির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়িয়ে এ
খাতে রাখা হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। সরকার এরই মধ্যে সব ধরনের সারের দাম
কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে। এ জন্যও ভতুর্কির চাপ কিছুটা কমে আসবে। আগামী
বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতো ১৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে
খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৫ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। সংশোধিত
বাজেটে এ খাতে অতিরিক্ত ৮১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে
খাদ্যে ভর্তুকিতে ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে।