দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে দিন কাটে বিয়াশ মেলার প্রতিষ্ঠাতা শিবশংকরের


সৌরভ সোহরাব, সিংড়া (নাটোর) প্রতিনিধিঃ , আপডেট করা হয়েছে : 08-05-2023

দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে দিন কাটে বিয়াশ মেলার প্রতিষ্ঠাতা শিবশংকরের

নাটোরের সিংড়া উপজেলার প্রধান কয়েকটি মেলা উৎসবের মধ্যে  সর্ববৃহৎ মেলা হচ্ছে বিয়াশ মেলা।

প্রতি বছর বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার ১ দিন ব্যাপী উপজেলার ২ নং ডাহিয়া ইউনিয়নের বিয়াশ স্কুল মাঠে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেই মোতাবেক এবছরের মেলা হচ্ছে আগামীকাল মঙ্গলবার। তবে মেলা আগামীকাল হলেও মেলা শুরু হয়েছে আজ সোমবার বিকাল থেকেই।

প্রায় তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে আসা এই মেলার প্রথম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শিবশংকর সুত্রধর। বিয়াশ মিস্ত্রি পাড়ায় জন্ম নেওয়া এই শিবশংকরেরর বয়স এখন ষাটের কাছা কাছি। এই বয়সে কোন কর্মেই নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। অভাব অনটনে সংসার চলে। দিন কাটে ভক্তি সাধনায়। মেলার ১ মাস আগে লাল শালু গায়ে বের হন। এক হাতে তীরশুল। অন্য হাতে মাটির পাত্র। পাত্রের মধ্যে ভাজ করে সাজানো মেলার দাওয়াতি পত্র। উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। দাওয়াত পত্র দিয়ে সর্বসাধারণের কাছ থেকে নেন অর্থ সহযোগিতা। এভাবে যে অর্থ জমা করেন ভক্তি সাধনায় কিছু অর্থ খরচ করেন বাকি টুকু দিয়ে চালান সংসারের খরচ। মেলার ১ মাস সবাই এই অর্থ সহযোগিতা করলেও মেলার পরের দিন থেকে আবারও অর্থহীন হয়ে পড়েন তিনি।  এভাবেই চলে যায় দিন। সারা বছর অভাব আর দরিদ্রের সাথে চলে যুদ্ধ।

মেলার প্রথম উদ্যোক্তা ও মেলা প্রতিষ্ঠাতা এই শিবশংকরের কাছ থেকে জানা যায় মেলা প্রতিষ্ঠার সেই পিছন ফেরার গল্প।

আজ থেকে প্রায় ৩৫ কি ৩৬  বছর আগের কথা। তখন তাঁর বয়স ২৫ কি ২৬ বছর। বাবার সংসারে থাকেন। কিশোর বয়স থেকেই শিবশংকর ছিলেন  জয়কালি মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। যখন যেখানে সময় পান মায়ের সেবা ও ভক্তি করার চেষ্টা করেন। যুবক বয়সে এসে মনে মনে ভাবেন মায়ের জন্য এমন কিছু করতে হবে যাতে এই ভক্তি ও সেবা স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। সেই কল্পনা আর ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত হয় মেলার উদ্যোগ। বিয়াশ কালিবাড়িতে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করা হলে একদিকে যেমন মায়ের পুজা হবে অন্যদিকে তেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের মিলন মেলার উৎসব হবে। এভাবেই ১৯৮৬ সালের বাংলা বৈশাখ মাসের শেষ মঙ্গলবার বিয়াশ কালি বাড়িতে  আয়োজন করা হয় প্রথম মেলা এবং মা কালির জন্য পাঠা বলির পুজা।  এভাবে পাঠা বলি দিয়ে পুজা করায় মেলার তেমন জৌলুস দেখা যায় নাই। কারন মুসলমান অধ্যুষিত এই অঞ্চলের কেউ মেলায় আসতো না । এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার মুখে  মেলার দিন পাঠা বলির পুজা বাদ দেওয়া হলে  ১৯৯২ সাল থেকে মুল মেলা উৎসব শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে কালি বাড়ি থেকে মেলা স্থানান্তর হয়ে বিয়াশ স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।

   মেলার প্রতিষ্ঠাতা শিবশংকর বলেন-প্রথম কয়েক বছর মেলায় লোকজন  ছিল কম। পরের কয়েক  বছর থেকেই মেলায় লোকজন বাড়তে থাকে। আমাদের হিন্দু ধর্মের পুজা দিয়ে মেলা শুরু হলেও কিছু দিন পর মেলায় পাঠা পুজা বাদ দেওয়ায়  এই অঞ্চলের হিন্দু মুসলিম সবাই অংশ গ্রহন করছে। এক সময় মেলার জায়গা স্থানান্তর করে বিয়াজ বাজারে নেওয়া হয়।
এভাবে ৮/১০ বছর পর মেলাটি সরকারী তালিকা ভুক্ত হওয়ায় কারনে সরকারী ভাবে মেলার ডাক হয়। স্থানীয় নেতা কর্মীরা কয়েক বছর আমার নামে মেলার ডাক দিলেও এখন তা আর দেওয়া হয়না। যারা ডেকে নেন তাদের কাছ থেকে একটি পয়সাও পাইনা।

আও শিবশংকর আরও বলেন-আমি জয় মা কালির ভক্তি সাধনা করি। যে যা দেন তা দিয়ে বোন রকম দিন কেটে যায়। অনেক সময় খেয়ে না খেয়েও দিন কাটে। তার পরও আমি ভালো আছি। ভালো আছি মানুষের ভালোবাসায়। অনেক মানুষই আমাকে চিনে। যখন কেউ জিজ্ঞেস করে মেলা কবে?  অভাবের মধ্যেও খুশিতে মনটা ভরে যায়। মানুষের এই ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে আছি।

শিবশংকর মুখে যতই ভালো থাকার ভান করুক। প্রকৃত অর্থে সে ভালো নেই। ভালো নেই তার পরিবার। তার পরিবারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল করুন দুর্দশার চিত্র। ছেলে মেয়ে সহ ৪ সদস্যের এই পরিবার অর্থ সংকটে এখন বড়ই অসহায়। স্কুল  পড়ুয়া মেয়ে সঙ্গীতা চিকিৎসার অভাবে পঙ্গুত জীবন নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছে। তিন বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার এক পা ভেঙ্গে যায়। চিকিৎসকরা বলেছেন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে ভালো হবে। কিন্তু মাত্র ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা জোগাড় করতে না পেরে মেয়েটার চিকিৎসা হচ্ছেনা। অর্থের অভাবেই কিশোর বয়সেই পঙ্গুত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে শিবশংকরের মেয়ে সঙ্গীতাকে।  সম্রাট নামের ছেলেটাকে লেখা পড়া করাতে হিমশিম খাচ্ছেন শংকর। অর্থের অভাবে মাঝে মধ্যেই স্কুলে যাওয়া হয়না সম্রাটের।

বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো যে মেলাকে কেন্দ্র করে বিয়াশ গ্রাম সহ আশ পাশের প্রায় ২০ টির মতো গ্রামের প্রায় ৫০/৬০ হাজার মানুষ আনন্দ উৎসব করবে। হাজার হাজার টাকা খরচ করবে। অথচ সেই মেলার প্রথম উদ্যাক্তা ও প্রতিষ্ঠার বাড়িতে হয়তো মেলার দিনও চাপা কান্না জেগে উঠবে। যে কান্না কেউ শুনতে পাবেনা।

জগতের সৃজনশীল বা শিল্প মনের ব্যক্তিদের জীবনে হয়তো এমনটাই হয়। যারা নিজের জীবন ও সংসারের জন্য কিছু না করে সমাজের জন্য কিছু করেন তাদের জগত সংসারের জীবন বোধ হয় এমনই অবস্থার সৃষ্টি হয়।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]