ভূমিকম্পসহ বড় বড় দুর্যোগে যেসব দোয়া পড়বেন


ধর্ম ডেস্ক: , আপডেট করা হয়েছে : 06-05-2023

ভূমিকম্পসহ বড় বড় দুর্যোগে যেসব দোয়া পড়বেন

মাঝে মাঝে মৃদু গতিতে কিংবা থরথর করে ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্প পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে হয়ে থাকে। যেখানে তীব্রতা বেড়ে যায়, সেখানে সব ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। ভূমিকম্পের মাত্রা ছোট কিংবা বড় হোক- এসবই বান্দার জন্য মহান আল্লাহর সতর্কবার্তা। তাহলে ভূমিকম্পের ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয় আমল ও দোয়া কী?

ভূমিকম্প থেকে বাঁচার দোয়া

মুমিন মুসলমানের জন্য যেকোনো বিপদে দোয়া ইউনুস সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো সংকট ও অস্থিতিশীল সময়ে এই দোয়া পড়া সুন্নত। আল্লাহর নবি হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম বিপদে পড়ে বারবার এই দোয়া পড়েছিলেন। তখন আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করে তাকে সংকট থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন-

لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

উচ্চারণ: ‘লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জলিমিন।’

অর্থ: ‘তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জালিমদের দলভুক্ত।’

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিদিন ভোরে ও প্রতি রাতের সন্ধ্যায় যে কোনো বান্দা এ দোয়াটি তিনবার পাঠ করবে কোনো কিছুই তার অনিষ্ট করতে পারবে না-

بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়ুন ফিল আরদি, ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামিউল আলিম।'

অর্থ: ‌আল্লাহ তাআলার নামে, যার নামের বরকতে আকাশ ও মাটির কোনো কিছুই কোনো অনিষ্টতা করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।'

ভূমিকম্প হওয়ার সময় আতঙ্ক না হয়ে বরং মাটির দিকে বা নিচের দিকে তাকিয়ে ভূমিকম্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়তে থাকা-

اَللهَ اَكْبَر اللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر- لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ لَا شَرِيْكَ لهُ - فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّکُمَا تُکَذِّبٰنِ

উচ্চারণ: ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, লা শারিকালাহু, ফাবি আইয়্যে আ’লাঈ রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।’

কোরআনের শেখানো ছোট্ট এ দোয়াটি পড়া-

ﺃَﻧﺖَ ﻭَﻟِﻴُّﻨَﺎ ﻓَﺎﻏْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﻭَﺍﺭْﺣَﻤْﻨَﺎ ۖ ﻭَﺃَﻧﺖَ ﺧَﻴْﺮُ ﺍﻟْﻐَﺎﻓِﺮِﻳﻦَ

উচ্চারণ: ‘আংতা ওয়ালিয়্যুনা ফাগফিরলানা ওয়ার হামনা, ওয়া আংতা খইরুল গাফিরিন।’ 

অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রক্ষক। সুতরাং আমাদের ক্ষমা করে দিন এবং আমাদের উপর করুণা করুন। তাছাড়া আপনি-ই তো সর্বাধিক ক্ষমাকারী।’ (সুরা আরাফ: আয়াত ১৫৫)

এছাড়াও যে কোনো দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এই দোয়া পড়া-

لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ اِلّا بِاللهِ

উচ্চারণ: ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ। ’ (বুখারি ও মুসলিম)

ভূমিকম্প থেকে বাঁচার আমল

ভূমিকম্প থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় আমল হলো- আল্লাহর অবাধ্যতা ছেড়ে দেওয়া। জীবনের সবকিছুতে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করে আত্মসমর্পণ করা। কারণ যখনই মানুষ আল্লাহর চরম অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। তখনই ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। বিষয়টি হাদিসের বর্ণনায় এভাবে ওঠে এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে কিন্তু তার খেয়ানত করা হবে,  জাকাতকে (ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা) দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে বাবাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল হবে, জাতির সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হবে নেতা, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে, তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হবে, মদ পান করা হবে, লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে, এমন সময় তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে এবং এমন একটি ভূমিকম্প হবে যা সেই ভূমিকে তলিয়ে দেবে।’ (তিরমিজি)

ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক সব দুর্যোগের কবল থেকে মুক্তির জন্য দরিদ্র ও মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের দান করাও উচিত। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা দয়া প্রদর্শন করো, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ)

তাইতো ভূমিকম্প হলেই হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার গভর্নরদের কাছে দান-সদকা করার প্রতি জোর দিয়ে চিঠি লিখতেন।

এছাড়াও সমাজে প্রচলিত জিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অবিচার যথাসাধ্য রোধ করা। হাদিস শরিফে এসেছে, সমাজে ব্যভিচার বেড়ে গেলে ভূমিকম্প হয়।

কোরআনে ভূমিকম্প

আল্লাহ তাআলা ভূমিকম্প সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমে ‘যিলযাল’ নামে একটি স্বতন্ত্র সুরাই নাজিল করেছেন। এছাড়া কোরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে ভূমিকম্প সম্পর্কে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَا نُرۡسِلُ بِالۡاٰیٰتِ اِلَّا تَخۡوِیۡفًا

মহান আল্লাহ বলেন, ‘…আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই। ’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ৫৯)

قُلۡ هُوَ الۡقَادِرُ عَلٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَ عَلَیۡکُمۡ عَذَابًا مِّنۡ فَوۡقِکُمۡ اَوۡ مِنۡ تَحۡتِ اَرۡجُلِکُمۡ

‘বলে দাও, ‘আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম...। ’ (সুরা আনআম: আয়াত ৬৫)

বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি। এগুলো দিয়ে তিনি তার বান্দাদের সাবধান করে থাকেন। কার্যত এগুলো মানুষের পাপ ও অপরাধের ফল। আল্লাহ বলেন-

وَ مَاۤ اَصَابَکُمۡ مِّنۡ مُّصِیۡبَۃٍ فَبِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِیۡکُمۡ وَ یَعۡفُوۡا عَنۡ کَثِیۡرٍ

‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।’ (সুরা শুরা: আয়াত ৩০)

হাদিসে ভূমিকম্প

ভূমিকম্প কেয়ামতের আলামত। তাই তা থেকে হেফাজত থাকতে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এ কারণেই হাদিসের একাধিক বর্ণনায় সতর্ক থাকার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেন মানুষ আল্লাহর কাছে ফিরে আসে। তওবা করে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং খুনখারাবি বাড়বে, তোমাদের সম্পদ এতো বাড়বে যে, উপচে পড়বে।’ (বুখারি)

হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘যখন তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’ আয়াতটি নাজিল হলো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’ (বুখারি)

ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক এসব বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত অবাধ্যতা ও অপকর্ম। যা দিন দিন বেড়েই চলছে। সাধারণত বিপদ-আপদ এলে সাময়িকভাবে কেউ কেউ পাপ ছেড়ে দেয়। কিন্তু কিছুদিন গেলে আবারও তারা পাপে জড়িয়ে পড়ে। বস্তুত  এগুলোই মানুষকে কেয়ামতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আল্লামা ইবনু কাইয়িম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মহান আল্লাহ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তখন এই ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মোনাজাত করে। আগেকার যুগে যখন ভূমিকম্প হতো, তখন সঠিক পথে পরিচালিত সৎকর্মশীল লোকেরা বলতো, ‘মহান আল্লাহ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। ’

ভূমিকম্প মানুষকে আরও সতর্ক করে যে, মানুষ যেন নিজেদের আচার-আচরণ শুধরে নেয়। কারো উপর জুলমু-অত্যাচার না করে এবং গুনাহ ও পাপ থেকে দূরে থাকে। আর সার্বিক নিরাপত্তার জন্য দোয়া করে। আল্লাহ তাআলাকে বেশি বেশি স্মরণ করে এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

সুতরাং প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের উচিত, খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা। একনিষ্ঠ তওবায় মিলবে আসমান ও জমিনের যাবতীয় দুর্যোগ থেকে মুক্তি। কোরআনুল কারিমে এ আয়াতই তার প্রমাণ। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনতো এবং (আল্লাহকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম। ’ (সুরা আরাফ: আয়াত ৯৬)

وَ لَوۡ اَنَّ اَهۡلَ الۡقُرٰۤی اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ بَرَکٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ کَذَّبُوۡا فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ

তাই যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ কিংবা ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে অতি দ্রুত তাওবা করা। তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে উল্লেখিত দোয়া ও আমলগুলো বেশি বেশি করার তাওফিক দান করুন। ভূমিকম্প, ভূমিধ্বস ও আসমান জমিনের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে হেফাজত করুন। আমিন।


Publisher & Editor :Md. Abu Hena Mostafa Zaman

Mobile No: 01971- 007766; 01711-954647

Head office: 152- Aktroy more ( kazla)-6204  Thana : Motihar,Rajshahi
Email : [email protected], [email protected]