শেষ হতে চলেছে বরকতময় মাস রমজান। অধিক সওয়াব পাওয়ার আশায় অনেকেই এ মাসে জাকাত দিয়ে থাকেন। অনেকেই জানেন না যে, জাকাতের টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় করা যাবে। কোন কোন ব্যক্তিকে দেওয়া যাবে জাকাতের টাকা। তাই জাকাতের টাকা দেওয়ার খাতগুলো তুলে ধরা হলো-
জাকাতের টাকা আট খাতে ব্যয় করা যাবে। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে জাকাতের টাকা খরচ করার খাতসমূহ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ الۡعٰمِلِیۡنَ عَلَیۡهَا وَ الۡمُؤَلَّفَۃِ قُلُوۡبُهُمۡ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الۡغٰرِمِیۡنَ وَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ؕ فَرِیۡضَۃً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ
‘নিশ্চয়ই সদাকা (জাকাত) হচ্ছে ফকির ও মিসকিনদের জন্য এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, আর যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের জন্য; (তা বণ্টন করা যায়) দাস আযাদ করার ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের মধ্যে, আল্লাহর রাস্তায় এবং মুসাফিরদের মধ্যে। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তওবা: আয়াত ৬০)
জাকাতের টাকা দেওয়ার খাতগুলো হলো-
১. ফকির: যাদের নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
২. মিসকিন: যাদের কোনো সম্পদ নেই।
৩. জাকাতের টাকা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি: যারা ইসলামি রাষ্ট্রের সরকারকর্তৃক জাকাত, সদকা, ওশর ইত্যাদি উসুল করার কাজে নিয়োজিত।
৪. ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করতে: ইসলামের দিকে ধাবিত করার জন্য জাকাত প্রদান । তবে এ খাতটি বর্তমান সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়।
৫. দাস আযাদ: নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস-দাসীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য জাকাতের টাকা দান করা।
৬. ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তি: পর্যাপ্ত পরিমাণ মাল না থাকার দরুণ ঋণ পরিশোধে অক্ষম ঋণী ব্যক্তিকে জাকাতের টাকা দেওয়া।
৭. মুজাহিদ: যারা যুদ্ধের অস্ত্র যোগাতে অক্ষম অথবা টাকার কারণে হজের কাজ পূর্ণ করতে অক্ষম বা ইলম হাসিল ও দ্বীনি দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত গরীব মানুষ।
৮. সফর: ভ্রমণ অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষকে দান করা।
জাকাত সম্পর্কিত কিছু মাসআলা
১. কোনো ধনী ব্যক্তি যদি তার জাকাতের টাকা দিয়ে কোনো গরীবকে শিক্ষা অর্জন ও দ্বীন প্রচার ইত্যাদি দ্বীনি কাজে পাঠায়- তাহলে তার জাকাত আদায় হয়ে যাবে। অনেক আলেম বলেন, এসব ক্ষেত্রে বরং সে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী হবে।
উল্লেখ্য, বর্ণিত খাতগুলোর মধ্যে জাকাত ইত্যাদি উসুলে নিয়োজিত ব্যক্তি ছাড়া সব ধরনের লোক গরিব হওয়ার কারণেই জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত। আর গরিবকে শর্তহীনভাবে জাকাতের অর্থ প্রদান জরুরি এবং সম্পূর্ণ মালিক বানিয়ে দেওয়া জাকাত আদায়ের পূর্বশর্ত। অতএব কাউকে কোনো কাজের জন্য জাকাতের টাকা দিয়ে বাধ্য করা উচিত নয়। বরং শর্ত করাও শরিয়তসম্মত নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ২/৪৫, ফাতহুল কাদির ২/২০৫)
২. জাকাতের টাকা পাওয়ার উপযুক্ত কোনো গরিবকে বিনা শর্তে ও বিনা স্বার্থে মালিক বানিয়ে দেওয়া- জাকাত আদায় হওয়ার জরুরি শর্ত। (তাবয়িনুল হাকায়েক ১/৩০০)
৩. শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জাকাতের উপযোগী গরিব-অসহায় ব্যক্তিকে জাকাতের টাকার নিঃশর্তে মালিক বানিয়ে দেওয়া জাকাত আদায়ের পূর্বশর্ত। মালিক বানানো ছাড়া জাকাতের টাকা ব্যয় করা হলে জাকাত আদায় হবে না এবং ব্যয়কারী গুনাহগার ও দায়ী হবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৮৮, মাজমাউল আনহুর ১/৩২৮)
৪. শরিয়তের দৃষ্টিতে জাকাত আদায় হওয়ার জন্য জাকাত পাওয়ার উপযোগী ফকির-মিসকিনকে নিঃস্বার্থে মালিক বানিয়ে দেওয়া পূর্বশর্ত। তাই জাকাতের টাকা দিয়ে গরিবদের ভরণ-পোষণ বাবদ খরচ করা যাবে। আর যে সমস্ত খাতে খরচ করলে গরিবদের মালিকানায় যায় না, যেমন- ঘর বানানো, পানি ও বিদ্যুৎ বিল, শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি খাতে জাকাতের টাকা খরচ করা যাবে না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৭০, আদ দুররুল মুখতার ২/৩৪৪)
৫. কোনো সংগঠনকে দেওয়ার দ্বারা জাকাত আদায়ের শর্ত পূরণ হয় না, তাই জাকাত আদায় হবে না। (আদ দুররুল মুখতার ২/৩৪৪, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৮৮)
৬. জাকাত আদায় হওয়ার জন্য জাকাতগ্রহীতা বালেগ হওয়া শর্ত নয়, বরং স্বেচ্ছায় খরচ করার বুঝ হয়েছে- এমন হলেই তাকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, নাবালেগ ছেলের পিতা ধনী হলে ছেলেকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার ২/৩৪৯, ২/৩৫৬)
৭. নিজের ঊর্ধ্বতন যথা বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও তাদের বরাবর উপরে এবং অধঃস্তন যথা ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ও তাদের বরাবর নীচে কাউকে জাকাত দেওয়া যাবে না। স্বামী-স্ত্রী একে-অপরকে জাকাত দিতে পারবে না। (ফাতহুল কাদির ২/২০৮)
৮. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে ভাই-বোন, চাচা, মামা, ফুফু, খালা ও তাদের সন্তানদের জাকাতের টাকা দিতে পারবে। (ফাতহুল কাদির ২/২০৯, রদ্দুল মুহতার ২/৩৪২)
৯. মেয়ের জামাই ও ভগ্নিপতিকে জাকাত দেওয়া যাবে, যদি সে জাকাতের উপযুক্ত হয়। (রদ্দুল মুহতার ২/৩৪৬)
১০. জাকাতের টাকা দিয়ে ক্রয়কৃত জিনিস পরবর্তীতে নিজে নিসাবের মালিক হয়ে যাওয়ার পরও নিজে ব্যবহার করতে পারবে। (ফাতহুল কাদির ২/২০৫)
১১. জাকাতের টাকার মালিক বানিয়ে দেওয়া জাকাত আদায়ের শর্ত। তাই মালিক না বানিয়ে দাওয়াত খাওয়ানোর দ্বারা জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার ২/২৫৭)
১২. দোকান, কারখানা বা বাড়ির কর্মচারী যদি গরিব ও জাকাত নেওয়ার উপযুক্ত হয় তাহলে তাদের নিঃস্বার্থ জাকাত দেওয়া জায়েয হবে, অন্যথায় জায়েয হবে না। তবে তাদের জাকাত দেওয়ার কারণে তাদের প্রাপ্য নিয়মিত পারিশ্রমিকের মধ্যে কোনো ব্যাঘাত যেন সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ জাকাত দ্বারা কারো হক আদায় করা যায় না। বেতন যেহেতু চাকরিজীবীর প্রাপ্য হক, তাই জাকাত দ্বারা বেতনের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবে না। (মুলতাকাল আবহুর ১/২৮৪, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম ৬/২৪৫)