রমজানের দিনগুলোতে ঝড়ো গতিতে দান-সাদকা করতেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের মধ্যে অনেকেই রমজানে দান-সাদকা করেন। আবার রমজানে সম্পদ পবিত্র করার সেরা মাধ্যম জাকাত দেওয়ারও সেরা সুযোগ।
রমজান মাস এলেই কিছু মানুষ জাকাতের কাপড় বিতরণ করে, যদিও এটি ইসলামি পদ্ধতি নয়। মূলত জাকাতের অর্থ জমা করতে হয় রাষ্ট্রীয় বায়তুল মালে তথা জাকাতের জন্য নির্ধারিত তহবিলে। এ অর্থ রাষ্ট্র উপযুক্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করবে।
নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ তেমনি জাকাত প্রদানও ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোর একটি। তাই পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা নামাজের পাশাপাশি জাকাত প্রদানের নির্দেশও দিয়েছেন। নামাজের সঙ্গে সঙ্গে জাকাতের সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িত।
নামাজ ও জাকাত ছাড়া ইসলামী জীবন গঠনই অসম্ভব। জাকাত আদায়ে বিরত থাকা ব্যক্তি সম্পর্কে কোরআন-সুন্নায় কঠিন শাস্তির বর্ণনা ওঠে এসেছে এভাবে-
১. আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ الَّذِیۡنَ یَکۡنِزُوۡنَ الذَّهَبَ وَ الۡفِضَّۃَ وَ لَا یُنۡفِقُوۡنَهَا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۙ فَبَشِّرۡهُمۡ بِعَذَابٍ اَلِیۡمٍ یَّوۡمَ یُحۡمٰی عَلَیۡهَا فِیۡ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُکۡوٰی بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَ جُنُوۡبُهُمۡ وَ ظُهُوۡرُهُمۡ ؕ هٰذَا مَا کَنَزۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ فَذُوۡقُوۡا مَا کُنۡتُمۡ تَکۡنِزُوۡنَ
‘যারা স্বর্ণ রৌপ্য মজুদ করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, হে নবি! তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ এবং পিঠকে সেক দেয়া হবে (এবং তাদের বলা হবে) এটা তার প্রতিফল যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে। সুতরাং তোমাদের ধনভাণ্ডারের শাস্তি আস্বাদন কর।’ (সুরা আত-তওবাহ : আয়াত ৩৪-৩৫)
২. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিয়েছেন কিন্তু সে তার জাকাত আদায় করে না, উক্ত সম্পদ কেয়ামতের দিন তার জন্য বিষধর সাপে পরিণত করা হবে। যার চোখের ওপর কালো দাগ পড়ে গেছে। অতপর তা স্বীয় চোয়ালদ্বয় দ্বারা তাকে কামড় মারবে এবং বলবে আমি তোমার ধনভাণ্ডার, আমি তোমার সম্পদ।’ (বুখারি)
সম্পদ পবিত্র করার মহাসুযোগ রমজান
প্রকৃত পক্ষে জাকাত আদায়ই সম্পদ ও ব্যক্তিকে পবিত্র করে। যেভাবে আল্লাহ পাক বলেন-
خُذۡ مِنۡ اَمۡوَالِهِمۡ صَدَقَۃً تُطَهِّرُهُمۡ وَ تُزَکِّیۡهِمۡ بِهَا وَ صَلِّ عَلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ صَلٰوتَکَ سَکَنٌ لَّهُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
‘তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ কর, যাতে তুমি সেগুলোকে পবিত্র করতে এবং সেগুলোকে বরকতময় করতে পার এর মাধ্যমে। আর তাদের জন্য দোয়া কর, নিশ্চয়ই তোমার দোয়া তাদের জন্য প্রশান্তিকর। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আত-তওবাহ : আয়াত ১০৩)
রমজানই জাকাত আদায়ের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাসে জাকাত আদায় করলে মিলবে বেশি সওয়াব ও উপকারিতা। কেননা রমজানের দান-সাদকার ফজিলত বেশি। যে কারণে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঝড়ের গতিতে বেশি বেশি দান-সাদকা করতেন।
জাকাত শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির নামই নয় বরং তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ফরজ ইবাদত। মানুষের সুখ শান্তির জন্য সুন্দর জীবন-যাপনের জন্য জাকাত সর্বোত্তম অর্থ ব্যবস্থা। তাই যার ওপর জাকাত ফরজ, তার জন্য রমজানে তা প্রদান করার সেরা সুযোগ।
ইসলাম শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয় নাই। বাস্তব জীবনে জাকাতকে ফরজ কার্যের আওতায় এনে তার প্রতিফলনও ঘটিয়েছে। জাকাত দ্বারা দরিদ্র জনসাধারণের জন্য একটি চিরস্থায়ী দানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জাকাত আদায় ও বণ্টনে বায়তুল মাল
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জাতীয় দৈন্য দুর্দশার মুক্তি সাধনায় বহু ত্যাগ স্বীকার করে তিনি বায়তুল মালকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে মুসলমান জাতির প্রাণশক্তি ছিল বায়তুল মাল। তখন জাকাতের অর্থ ওঠানোর জন্য আদায়কারী নিযুক্ত ছিল। তারা নিয়মিত জাকাত আদায় করে বায়তুল মালে জমা দিতেন এবং তা থেকে দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে যথাযথ নিয়মে তা বণ্টন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারকল্পে ব্যয় করতেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় সাহাবাদের অনেকেই ছিলেন দরিদ্র ও অভাবী। নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে তারা বহু অভাব অনটনে থাকা সত্বেও আল্লাহর পথে দ্বীনের কাজের জন্য বহুবিধ পথে তারা সম্পদ ব্যয় করতেন। এ সব সাদাকাতের মধ্যে জাকাত ছিল অগ্রগণ্য ও সর্বব্যাপী।
সব জিনিসের ওপর জাকাতের একটি অংশ বরাদ্ধ ছিল। উৎপাদিত ফসলের ওপর, বানিজ্য পণ্যের ওপর, ঘোড়া, উট ও গবাদি পশুর ওপর, বাগ-বাগিচাসহ সব সম্পদের ওপরই জাকাতের নির্দেশ ছিল। তাদের দরিদ্র ও অভাব সত্বেও কখনো কোনো নির্দেশে তারা আপত্তি তোলেননি। অধিকন্তু পরম আন্তরিকতা ও উদারতার সঙ্গে জাকাত ও দান-সাদকা করে গেছেন।
অথচ বর্তমান যুগে অনেকের কাছেই বহু অর্থ-সম্পদ রয়েছে কিন্তু জাকাতের প্রতি কোনো মনোযোগ নেই। ভাবনা চিন্তাও নেই। এছাড়া জাকাত আদান প্রদানের সঠিক তেমন কোনো বায়তুল মালের কার্যকরী ব্যবস্থাও দেখা যায় না।
তাই পবিত্র এ রমজান মাসে বেশি বেশি নামাজ আদায়ের পাশাপাশি জাকাত প্রদানে সোচ্চার হয়ে অসহায়দের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো জরুরি। তবেই আল্লাহর হক এবং বান্দার হক সঠিকভাবে আদায় করার মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলার জান্নাত পাওয়ার পথ সুগম হবে। আল্লাহ তাআলা যেভাবে বলেছেন, জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদকে তিনি পবিত্র ও বরকতময় করবেন।
তাই আসুন, রমজানেই ধন-সম্পত্তির হিসাব করে জাকাত প্রদান করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নেই। আল্লাহ তাআলা সবাইকে সম্পদের সঠিক হিসাব করে জাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। জাকাত আদায়ে রমজানই হোক নিজেদের সম্পদ ও জীবনকে পবিত্র করার মহাসুযোগ। আমিন।